বৃষ্টি থামলেও দুর্ভোগ কমেনি চট্টগ্রামবাসীর

পানিতে তলিয়ে আছে চট্টগ্রামের অনেক এলাকা। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

সকাল থেকে বৃষ্টি না হলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বন্যার পানি না নামায় আজ বুধবারও মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। 

এতে মহাসড়কের চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলা অংশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এসময় সড়কের দুই পাশে কয়েকশ যানবাহন আটকা পড়ে। ফলে মানুষকে তীব্র ভোগান্তি পোহাতে হয়।

চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়ায় যানজটে আটকে পড়া লরিচালক আশরাফ উল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকে তিনি যানজটে আটকা পড়েছেন। 

ডুবে যাওয়া সড়কে তীব্র যানজট। ছবি: স্টার

তিনি বলেন, 'আমাকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় যেতে হবে। কিন্তু না পারছি সামনে যেতে, না পারছি পেছনে ফিরতে। এখানে প্রায় ২৩ ঘণ্টা ধরে আটকে আছি।'   

'দুই দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া তেমন কিছুই করতে পারছি না এবং খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। গাড়ি রেখে কোথাও যেতেও পারছি না। আশপাশে কোনো হোটেলও নেই। আমার সহকারী ৩ কিলোমিটার হেঁটে কাল একটি দোকান থেকে পাউরুটি-কলা নিয়ে এসেছিল। তা দিয়ে রাতে ও সকালে নাস্তা সেরেছি', যোগ করেন আশরাফ উল্লাহ।

আরেক লরিচালক তবারক জানান, গতরাতে জেগে থাকায় তিনি অসুস্থ বোধ করছেন।  

'ড্রাইভিং সিটে ঘুমানো সম্ভব নয়। মশার যন্ত্রণায় ঘুমও আসে না। যদি পারতাম ফিরে যেতাম, কিন্তু পারছি না, কারণ দুই দিকেই দীর্ঘ যানজট', বলেন তিনি।

সড়কে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে যানবাহন। ছবি: স্টার

রাজশাহী নগরীর মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মোট ৪০ জন স্টাফ কক্সবাজারে পিকনিক করতে গতকাল রওনা হয়ে আজ ভোর থেকে সাতবাড়িয়া এলাকায় ৩ ঘণ্টা ধরে জ্যামে আটকে ছিলেন।   

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্টাফ সাজু আহমেদ জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বন্যার পানি জমে আছে তা তারা জানতেন না।  

তিনি বলেন, 'আমরা এখন কী করব বুঝতে পারছি না। কতক্ষণে কক্সবাজার পৌঁছাতে পারব জানি না।'

চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পানি নামতে শুরু করেছে এবং সকাল থেকে একপাশে ধীরগতিতে যান চলাচল করছে।'

চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির ৯ আগস্টের চিত্র। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

তবে এ প্রতিবেদক সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাতবাড়িয়া এলাকায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও ওই স্থানে কোনো বাস বা লরি সামনে এগিয়ে যেতে দেখেননি। প্রায় সব যানবাহনই ঠাই দাঁড়িয়ে ছিল।
 
চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘর-বাড়ি ও আঙিনায় এখনো বন্যার পানি জমে আছে। মানুষ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ গবাদিপশুও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। 

সাতবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

এখানে আশ্রয় নেওয়া সাদেক পাড়ার জেবর হোসেন জানান, মঙ্গলবার তার বাড়িতে পানি প্রবেশ করে। তাই পুরো পরিবার নিয়ে স্কুলে আশ্রয় নেন তিনি। 

তিনি জানান, এই ২ দিনে কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের দেখতে আসেননি। স্থানীয় আব্দুল ওয়াহাব মাস্টার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার দুপুরে খিচুড়ি ও রাতে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়।
  
খানদীঘি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়েও প্রায় ২ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

স্থানীয় নাথ পাড়ার অজিত দেবনাথ, দারিকা মোহন দেবনাথ, দুলাল নাথ ও মানিক নাথ প্রমুখ পরিবার নিয়ে সেখানে আশ্রয় নেন।

তারা জানান, এখন পর্যন্ত কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের দেখতে আসেননি। স্থানীয় বিত্তবানরা তাদের দিনে ৩ বার শুকনো খাবার বিতরণ করছেন।

স্থানীয়রা জানান, এলাকার প্রায় ৫০টি পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর জমির বীজতলা।

পূর্ব সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কৃষক বাদশা মিয়া জানান, বৃষ্টিতে তার রোপণকৃত সব বীজ নষ্ট হয়ে গেছে।

স্থানীয় নজরুল ইসলাম আউশ ধান চাষ করেছিলেন। আগামী মাসে ফসল তোলার কথা ছিল। 

তিনি জানান, বন্যার পানিতে তার সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চাষাবাদের খরচ কীভাবে তুলবেন তা নিয়ে চিন্তিত।

'সরকার আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না', প্রশ্ন তার।

বৃষ্টিতে রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ছবি: স্টার

সাদেক পাড়া থেকে একটু এগিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় জমে থাকা পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন লোকজন। 

স্থানীয় রুবেল সিকদার বলেন, 'কী আর করব। বন্যার পানিতে আমাদের পুকুর তলিয়ে সব মাছ বেরিয়ে গেছে। তাই দেখছি- জাল দিয়ে কিছু মাছ ধরা যায় কি না।'

স্থানীয়রা আরও জানান, মঙ্গলবার থেকে এই এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। 

স্থানীয় অভি নাথ বলেন, 'আমরা মোবাইল ফোন চার্জ পর্যন্ত করতে পারছি না। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। নলকূপগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় কয়েক মাইল পথ হেঁটে পানীয় জল সংগ্রহ করতে হচ্ছে।'
  
স্থানীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তদের শুকনো খাবার ও খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বন্যার্তদের মধ্যে সরকারি ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করা হচ্ছে।'
 
বন্যা পরিস্থিতির একই চিত্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে চন্দনাইশের পার্শ্ববর্তী অন্য ২ উপজেলা সাতকানিয়া ও লোহাগাড়াতেও। লোকজন পানিতে আটকে আছেন। ৩ দিন ধরে উপজেলার কোনো গ্রামেই বিদ্যুৎ নেই। বিশুদ্ধ পানির অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্যার্তরা। 

সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত। কয়েকশ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। শত শত হেক্টর জমির বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'এলাকায় শুকনো খাবার ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। আগ্রহী লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।'

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে থাকা লোহাগাড়া উপজেলার এসি (ভূমি) মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, তার উপজেলায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি এবং পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, শুকনো খাবার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

11h ago