আজিমের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্ত্রী অভিনেত্রী সুজাতার লেখা

নায়ক আজিম
আজিম ও সুজাতা। ছবি: সংগৃহীত

২০০৩ সালের ২৬ মার্চ মারা যান বরেণ্য অভিনেতা আজিম। আজ এই চলচ্চিত্র অভিনেতার ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে নিয়ে লিখেছেন তার স্ত্রী 'রূপবান'খ্যাত অভিনেত্রী সুজাতা।

সেই লেখার অংশবিশেষ দ্য ডেইলি স্টার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

আজিম একজন বরেণ্য অভিনেতা ছিলেন। তাঁকে হারিয়ে এই ২০ বছরে শুধু একটি কথাই বারবার মনের মধ্যে উচ্চারিত হয়, তার কি একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও প্রাপ্য নয়! মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে রাষ্ট্র এত বছরেও স্বীকৃতি দিতে পারল না! এটা নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই, চরম দুঃখবোধ আছে।

আমার এক ছেলে ফয়সাল আজিম, পুত্রবধু, দুই নাতি—এদের নিয়ে জীবনযাপন। জানি না আমি কতদিন বাঁচবো, আমার বয়সও তো কম হলো না। তবে এই দুঃখবোধ নিয়েই কি মরতে হবে! যদি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পেতেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতেন—হয়তো স্ত্রী হিসেবে শান্তিতে মরতে পারতাম। আমার সন্তান নাতিরা গর্ব নিয়ে বাঁচতে পারতো।

একজন যথার্থ মানুষকে সম্মাননা না দেওয়ায় রাষ্ট্রের দায় থেকে যায়। আজিম অস্ত্র হাতে ময়দানে যুদ্ধ করেনি। তবে তিনি ছিলেন অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করা যোদ্ধাদের চরম সময়ের বন্ধু। জীবন বাজি রেখে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাই বলতেই পারি, একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালে ২ হাত বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন।

উনি মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করতেন কিছু উদাহরণ দেই।

আমাদের ১৯৬৭ সালে বিয়ে হয়। ১৯৭১ সাল চলে আসে। সারাদেশে যুদ্ধ চলছে। শাশুড়ির কথায় আমাকে একটি গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। তখন গাড়িটির দাম ছিল ২৫ হাজার টাকা। একমাস আগে কিনে দেওয়া নতুন গাড়িটি বিক্রি করে সবগুলো টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেন। আমাকে বলেছিলেন, সবার আগে প্রয়োজন দেশ, গাড়ি বেঁচে থাকলে কেনা যাবে। তখন তো শুটিং বন্ধ ছিল। যুদ্ধ চলছে। হাতে তো ওভাবে টাকা ছিল না। যেভাবে সম্ভব হয়েছে আজিম টাকা জোগাড় করে দিতেন।

একদিন এক মুরগিওয়ালা এসেছেন। তার কাছ থেকে দুইটা মুরগি নিলো আর অনেকগুলো টাকা দিল। আমার চোখে পড়লো। বললাম, এতগুলো টাকা দিলে আর দুইটা মুরগি নিলে। উনি আমাকে ডেকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো, আস্তে কথা বলো। উনি মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধারা নানা ধরনের বেশে আসতেন, আজিম ওনাদের কী সাহায্য করবেন তা জোগাড় করে রাখতেন।

আমি একটি বই লিখেছি 'শিমুলির একাত্তর' নামে সেখানেও এই কথাগুলো আছে। সেখানে আরও বিস্তারিত আছে। এখনো বেঁচে আছেন সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন মায়া। উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। উনি জানেন আজিমের অবদান। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর ছোট ভাই ফতেহ আলীও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারাও জানেন এইসব ঘটনা। এমন অনেকে আছেন যাদের হয়তো তখন আমি চিনে উঠতে পারিনি।

অভিনেত্রী সুমিতা দি থাকতেন এফডিসির ফ্লোরে, তাকে সাহায্য করতেন গিয়ে। চিত্রপরিচালক প্রদীপ দে এখনো বেঁচে আছেন—উনিও জানেন আজিম সাহেবের অবদান।

স্বাধীনতার পরে আমরা আবার শুটিং শুরু করলাম। কয়েকজন স্বনামধন্য পরিচালক ও এফডিসিকে আজিম উপহার দিয়েছেন। যেমন ইয়ার খান, আকবর কবির পিন্টু, আকবর হুদা মিন্টুকে পরিচালক বানিয়েছেন।

জসিম ওনার হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছেন। জসিমের 'দোস্ত দুশমন' ছবির প্রায় সমস্ত ব্যয় উনি করেছিলেন। জসিম শুধু ১০ হাজার টাকা খরচ করেছিল। তখন এত ট্রান্সপোর্ট ছিল না। উনি নিজের গাড়ি দিয়ে শুটিংয়ের পর শিল্পী কলাকুশলীদের পৌঁছে দিতেন। তার কাছে কিছু চেয়ে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফেরেননি। এতোটাই উদার মনের ছিলেন তিনি।

আজিম অভিনীত সিনেমা 'হারানো দিন', 'নতুন সুর', 'মেঘ ভাঙ্গা রোদ', 'ডাকবাবু', 'সাইফুল মুলক বদিউজ্জামান', 'সাত ভাই চম্পা' ও 'ভানুমতি'। তার পরিচালিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে—'টাকার খেলা', 'প্রতিনিধি', 'জীবন মরণ', 'বদলা', 'গাদ্দার', 'দেবর ভাবী'।

'মালা', 'ডাকবাবু', 'আমির সওদাগর', 'ভেলুয়া সুন্দরী', 'মধুমালা', 'রাখাল বন্ধু' প্রভৃতি ছবিতে আমার নায়ক ছিলেন আজিম।

তিনি ১৯৩৭ সালের ২৩ জুলাই সিলেটের হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন মুন্সেফ। তাই আজিমের শৈশব-কৈশোর কাটে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পরবর্তীতে ঢাকার হাটখোলার ভবগতী ব্যানার্জী রোডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

২০০৩ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

16h ago