‘লেপে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’
'হে সূর্য
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের এ উলঙ্গ ছেলেটাকে'!
…কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য
শীত এলে কবি সুকান্তর মতো জীবনানন্দ কিংবা চেখভের কথা বেশি মনে পড়ে। আন্তন চেখভ এক ভিন্ন দৃষ্টি নিয়ে শীতকে মেপেছিলেন এই বলে যে, 'মানুষ সুখে থাকলে পরখ করে দেখে না কোনটা শীত আর কোনটা বসন্ত'।
আমার পরিচিত এক 'ন্যাংটা ফকির' আছেন। শীত এলে তার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে জাগে, কিন্তু দেখা হয় না। এই ফকির শীতকালে ভক্তদের সঙ্গে কেন দেখা করেন না, সেটা এক রহস্য। তবে ভারতের অনেক ন্যাংটা ফকিরকে প্রবল শীতেও রাস্তা-ঘাটে দেখা যায়। তারা যেভাবে উদোম গায়ে শীতকে 'ট্যাকেল' করেন, সেটা বোধ হয় এক শিল্প।
তবে কবি সুকান্ত এমন কারো জন্য সূর্যের কাছে কিছু চাইতেন কি না, জানি না। অন্যদিকে জীবনানন্দের ভাবনাটা দীর্ঘশ্বাসের। তিনি লিখেছিলেন, 'এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে'। শীতের সবজি, পিঠা কিংবা আখের রস যে কারণেই হোক না কেন কবি ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত শীতকে উপভোগ করতেন। বলতেন, শীত নাকি 'ঋতুশ্রেষ্ঠ'।
কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনা ভাবতেন বৃষ্টির সমঝদার খ্যাত কবি কালিদাস। তার মতে, শীতে মেয়েদের ভেতর কামভাব প্রবল হয় বলে পুরুষরা শীতকে এত গুরুত্ব দেয়। সারা বছর বরফের নীচে থাকা অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের একটা প্রবাদ এমন, শীত সবকিছু ঠাণ্ডা করলেও যৌবন গরম রাখে।
শীতকে খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড় ও তার রাজা। একদিন রাজা গোপাল ভাঁড়কে ডেকে বললেন, শীতের এই সময়ে সারারাত পুকুরে থাকতে পারলে গোপালকে পুরস্কৃত করা হবে। গোপাল পুকুরে নামলেন আর রাজা পুকুরের চারপাশে মশাল জ্বালিয়ে দিলেন। পরদিন রাজ দরবারে গোপাল পুরস্কার চাইলে রাজা বললেন, মশাল জ্বালানোর কারণে গোপালের শীত লাগেনি, তাই সে পুরস্কার পাবে না। গোপালের মন খারাপ হলো। সে কিছুদিন পর রাজাকে বাসায় দাওয়াত দিলো। রাজা দেখলেন, চুলা জ্বলছে নীচতলায়, আর দোতলার ছাঁদে রাখা পাতিলে দেওয়া হয়েছে ভাত আর মাংস। সারাদিন চুলা জ্বললো, কিন্তু রান্না আর হলো না। রাজা সব বুঝে গোপালকে কিছু না বলেই চলে যান দরবারে।
শীত অবশ্য রাজা বা গোপাল ভাঁড়কে 'কেয়ার' করে না। সে তার ইচ্ছে মতো আসে কিংবা যায়। সারা পৃথিবীতে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে 'শীতের অভ্যাসে'ও পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে গরমের সময়ে বেশি গরম পরে, সেখানে ঠাণ্ডাও আজকাল বেশি পরছে। হয়তো বরফ পরবে কয়েক বছর পর।
সারা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মরুভূমির দেশ সৌদি আরবে বন্যা হচ্ছে, আমেরিকা, কানাডা কিংবা ইউরোপের দেশে যেমন তুষারপাত কিংবা দীর্ঘস্থায়ী বরফপাতের দেখা মিলছে, তেমনি দেখা দিচ্ছে বন্যা বা দাবানল। শীতকে তাই আর আগের মতো চিনতে পারছে না পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।
শার্ল বোদলেয়ার শীতকে কতখানি চিনেছিলেন? তার কাছে শীত ছিল 'আগাগোড়া এক বিষণ্ণ ঘাতক'। সাপ আর ব্যাঙের মতো উভচর প্রাণী হয়তো শীতকে সবচেয়ে ভালো চিনতে পেরেছিল। শীত এলেই এরা শীত নিদ্রায় যায়। সাপ নাকি এ সময় তার খোলস বদলায়। শীতে অনেক গাছের পাতা ঝরে যায়। সেকারণেই কি না জানি না, জীবনানন্দের মতো বুদ্ধদেব বসু শীত এলে মরে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেন।
শীত নিয়ে আপনি যে ধারণাই পোষণ করেন না কেন, এই ঋতু নিয়ে সবচেয়ে বেশি হাসাহাসি করে রাশিয়ানরা। যেমন: পুলিশ স্টেশনে ফোন করে একজন বলছে, প্রচণ্ড শীত, কী করলে আমার আর আমার বউয়ের শীত কম লাগবে? পুলিশ জানালো, আপনার স্ত্রীর সামনে শাশুড়ি আর শশুড়কে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলুন। দেখেন বউ আপনাকে কীভাবে গরম করে তোলে। ছোট্ট বাচ্চাদের মধ্যে যারা চালাক, তারা শীতেও আইসক্রিম খেতে চায়। মা বারণ করলে বলে, মা আইসক্রিমটা একটু গরম করে দাও।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। রাশিয়ার সঙ্গে কেউ যুদ্ধে জড়ালে শীতকাল কারো জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না। শীত আর বরফের দিনগুলো কেটে গেলে যুদ্ধ করতে বোধ করি মজা লাগে। রাশিয়ার অয়মিয়াকন হচ্ছে পৃথিবীর শীতলতম জায়গার একটি। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি, এককালের কৌতুক অভিনেতা, জেলেনোস্কি বলেছেন (সত্য মিথ্যা নির্ণীত হয়নি), রাশিয়ার পুতিনের অধীনে যুদ্ধ করার চেয়ে নাকি অয়মিয়াকনে জমে মরাও অনেক আনন্দের। জেনে রাখা ভালো যে স্ট্যালিনের আমলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অয়মিয়াকনে নির্বাসনে পাঠানো হতো।
শীতে আপনি আসলে কী কী করতে পারেন?
১. শাস্তি হিসেবে ক্রসফায়ারের পরিবর্তে অপরাধীদের জামা-কাপড় ছাড়া বাংলাদেশের শীতলতম স্থানে পাঠিয়ে দিতে পারেন। শীতের সময়ে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে বেড়াতে যেতে পারেন, যেতে পারেন অন্য কোনো দেশে তুষারপাত দেখতে।
২. বর্ষা এ দেশের প্রজনন ঋতু। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন, 'ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে'। আর শীত বিয়ের ঋতু। এ দেশে সবচেয়ে বেশি বিয়ে হয় শীতে। সুতরাং আপনিও এই শীতে বিয়ে করে ফেলতে পারেন।
৩. উত্তরবঙ্গে কবে থেকে বরফ পরবে, সেই গবেষণায় লিপ্ত হতে পারেন। আর বরফ পরা শুরু হলেই আমেরিকার স্টানলি, অ্যান্টার্কটিকার ভোস্তক, কানাডার স্নাগ কিংবা আলাস্কার প্রসপেক্ট ক্রিগের মতো পৃথিবীর শীতলতম স্থানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো জায়গার নামও উচ্চারিত হওয়া শুরু করবে।
৪. শীত এলে বাংলাদেশে 'সাওনা'র প্রচলন করতে পারেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর প্রচলন আছে। গরমের ভাপ নিয়ে (স্টিম বাথ) এমন গোছল বা সাওনার প্রচলন এ দেশেও ছিল। ছন বা খড়ের কৃত্রিম ঘরের মতো বানিয়ে ভোরে সেগুলো জ্বালিয়ে তার পাশে স্নানের রেওয়াজ ছিল। রবীন্দ্রনাথের 'সামান্য ক্ষতি' কবিতার মাধ্যমে রাজার মহিষী করুণার প্রজাদের ঘর পুড়িয়ে গরম পোহানোর ঘটনা আমরা জেনেছিলাম। কবিতার মতো একালে রাজাও নেই, রানীর শাস্তির ব্যবস্থাও নেই।
৫. আপনি শীত উদযাপন করতে পারেন। ড্রয়িংরুমের কোনায় ভাপা কিংবা চিতই পিঠা বানাতে পারেন। শীতের সিটি ভার্সন এই দুই পিঠা। এ ছাড়া, খেজুরের রস স্ট্র দিয়ে খেতে পারেন। রাতে তালের রসের তাড়ি দিয়ে মাস্তি করতে পারেন।
৬. শীতে রুম হিটার কিংবা গরম কাপড়ের 'সিজনাল' ব্যবসা শুরু করতে পারেন। শীতের দোহাই দিয়ে অফিস কামাই দিয়ে বাসায় বসে শীতের পিঠা আর শাকসবজি আয়েশ করে খেতে পারেন।
৭. 'শীত জাদুঘর' বানাতে পারেন। শীতের কবিতা, গান (সিনেমার 'আইটেম সং' আছে প্রচুর। যেমন: নায়িকার নাচের সঙ্গে গান, 'আমার শীত শীত লাগে, শীত শীত লাগে'। নায়কের উত্তর, 'আমার কাছে আগুন আছে, কাছে আয় না'), বরফের ভাস্কর্য, শীতের পাখি, পিঠা, সবজি, খাবার, রোগ-শোক এমন সবকিছুর ছবি ও জাদুঘর ভার্সন রাখতে পারেন এই জাদুঘরে।
শীত নিয়ে আর কী বাকি থাকলো? কবিতা? কোন নেতা, কবি, লেখক কীভাবে লিখতেন শীত নিয়ে?
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'নীল নবঘনে শীতের গগণে কুয়াশা ছাড়া কিছু নাহিরে/ওরে আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।'
২. কাজী নজরুল ইসলাম, 'আমি আসিয়াছিলাম পুনঃ আসিয়াছি/ তোমাদের ঠাণ্ডা হেতু/ আমি স্রষ্টা শনির পছন্দের শীত ঋতু।'
৩. জীবনানন্দ দাশ, 'পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে "ওম" নিয়ে চলে গেছে দূরে/আবার শীতরে কেন ডেকে আনো? কে হায়হৃদয় খুঁড়ে ঠাণ্ডা লাগাতে ভালোবাসে?'
৪. হুমায়ূন আহমেদ, 'ন্যাংটা ফকির এক বিস্ময়। শীতের সকালে আঙুল কাটা জগলু ভেবে পেল না ফকির সাহেব কীভাবে হেঁটে যাচ্ছে। ফকিরের কাছ থেকে শীত হজম করাটা শিখতে হবে।'
৫. আনিসুল হক, 'তুই কী আমার শীত হবি? যারা শীত এনেছিল তুই কী তাদের সঙ্গী হবি?'
৬. মাওসেতুং, 'মাফলার, জ্যাকেট ও সোয়েটার দিয়ে শরীর ঘেরাও করো। প্রতিক্রিয়াশীল শীতকে রুখতে এমন ঘেরাওয়ের বিকল্প নেই।'
৭. লেনিন, 'শীতকালে স্নান হচ্ছে স্বৈরাচারী শাসকদের অত্যাচারের চরম পর্যায়।'
এমন উদাহরণ আরও টানা যায়। এবার তাহলে কৌতুক।
শীতের সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন এক নদীর তীরে ছিনতাইকারীর মুখোমুখি হলো প্রেমিক-প্রেমিকা। ছিনতাইকারী ছুরি বের করে বললো, 'যা আছে সব দে। ঝটপট। নাহলে ভূরি বের করে ফেলবো।' প্রেমিক মানিব্যাগ বের করলো। ঘড়ি খোলার সময় প্রেমিকা ছিনতাইকারীকে বললো, 'এখন তো সব ব্যবসায় অফার চলছে। আপনার পক্ষ থেকে কোনো অফার নেই?' ছিনতাইকারী বললো, 'তোর প্রেমিককে নদীতে ঝাঁপ দিতে বল। তাহলে ওর কাছ থেকে কিছু ছিনতাই করবো না।'
ফলাফল হলো ভয়াবহ। প্রেমিক দ্বিগুণ বেগে সবকিছু ছিনতাইকারীর কাছে দিয়ে বললো, 'এই শীতে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার চেয়ে আপনার ছুরির পোঁচ খাওয়াও অনেক ভালো।'
হয়তো শীত পোহানো আর শীত উপভোগের মধ্যে পার্থক্য আছে। শীত নিয়ে কোনো ব্যবসা হোক, চাই না। কোটি মানুষকে গরীব বানিয়ে এনজিওর কম্বল বা বড়লোকের পুরনো জামা-কাপড় দিয়ে সেবা ও উপকারের নামে তাদের নিত্য অপমান করতেও চাই না।
বদলে যাওয়া আবহাওয়া যেমন করে আমাদের নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে, জানি না ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শীতের রঙ কেমন হবে।
Comments