পর্দায় মৃণাল সেন হয়ে ওঠা অঞ্জন দত্ত
একজনের বয়স তখন ৫৭ বছর, অন্যজনের ২৪ কিংবা তারচেয়ে কিছু বেশি। একজন তখন সুপরিচিত চলচ্চিত্র নির্মাতা, অন্যজন পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি থিয়েটার করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। বছরখানেক আগে একটি 'ছোট সাক্ষাৎকার' নিতে গিয়ে সেই নির্মাতার সঙ্গে তার পরিচয়। পরবর্তীতে সেই পরিচয় রূপ নেয় গভীর বন্ধুতে, যাতে বাধ সাধেনি বয়সের ব্যবধান।
বলছিলাম 'গুরু' মৃণাল সেন ও 'শিষ্য' অঞ্জন দত্তের কথা। নিজেকে মৃণাল সেনের ছাত্রই বলেন অঞ্জন। আজকের অভিনেতা, নির্মাতা ও গায়ক অঞ্জন অবলীলায় স্বীকার করেন তার জীবনে মৃণাল সেনের প্রভাবের কথা। জানান, মৃণাল সেন না থাকলে সিনেমার জগতে আসাই হতো না তার।
১৯৮১ সালে মৃণাল সেনের 'চালচিত্র' সিনেমায় অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই প্রথম পর্দায় আবির্ভাব ঘটে তরুণ অঞ্জন দত্তের। দার্জিলিংফেরত অঞ্জনের তখনো কলকাতার প্রতি ওই অর্থে ভালোবাসা জন্মায়নি। কিন্তু ভাগ্য তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় মৃণাল সেনের সঙ্গে। পরে মৃণালই খুঁজে নেন অঞ্জনকে, চালচিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। 'চালচিত্র' যাত্রার মধ্য দিয়ে কেবল প্রথম পর্দায় আবির্ভাবই নয়, কলকাতার প্রেমেও পড়েন অঞ্জন, যার কৃতিত্ব 'গুরু' মৃণালের।
এরপর বইতে থাকে সময়ের স্রোত, অঞ্জনও একাধারে হয়ে ওঠেন অভিনেতা, নির্মাতা, গায়ক… পান জনপ্রিয়তা। তার গান কিংবা সিনেমায় পাওয়া যায় কলকাতা কিংবা কলকাতাকেন্দ্রিক মানুষগুলোর গল্প, যারা হয়তো খুব সাধারণ হরিপদ কেরানি, আলীবাবা কিংবা স্যামসন। কিন্তু তার কোনো কাজেই সেভাবে উঠে আসেনি 'গুরু'র প্রতিচ্ছবি।
অবশেষে মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে তাকে ট্রিবিউট করে সিনেমা বানিয়েছেন অঞ্জন, নাম 'চালচিত্র এখন'। মৃণাল সেনের সঙ্গে নিজের জীবনের গল্প নিয়ে নির্মাণ করা সিনেমায় মৃণালের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জন নিজেই। সিনেমায় তরুণ অঞ্জন দত্তের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাওন চক্রবর্তী। আরও আছেন সুপ্রভাত দাস, বিদীপ্তা চক্রবর্তী প্রমুখ।
শুক্রবার বিকেলে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবস্থল রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে দেখানো হয় সিনেমাটি। দর্শকদের সঙ্গে বসে সিনেমাটি দেখতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন অঞ্জন দত্ত। সিনেমার প্রদর্শনী শুরুর আগে আয়োজকরা তাকে মঞ্চে যেতে অনুরোধ করেন।
শুরুতেই ঢাকায় সিনেমাটির প্রদর্শনী ঘিরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। জানান ঢাকার প্রতি ভালোবাসার কথা। অঞ্জন বিশ্বাস করেন, তার দর্শক-ভক্তদের অর্ধেক বাংলাদেশের। সেই কারণেই কলকাতার মতো ঢাকা ঘিরেও তার রয়েছে অন্যরকম অনুভূতি।
অঞ্জন দত্ত বলেন, 'উনার শত বছর। আমার মনে হলো আমার দিক থেকে কিছু করা উচিত। আমার কোনো গানে, সিনেমায় কিংবা থিয়েটারে মৃণাল সেন আসেননি। কেন আসেননি আমি জানি না। তিনি এতই ব্যক্তিগত যে, দূর থেকে তাকে দেখতে আমার সময় লেগেছে। দূর থেকে না দেখলে তাকে নিয়ে কী করে আমি সিনেমা করব? মাথায় তুলে মৃণাল সেন একটা বিশাল লোক, এটা আমি বলতে পারব না। তিনি মানুষ, আমাদের মতোই মানুষ, মজার মানুষ। তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন, শিখিয়েছেন। কিন্তু তাকে আমি ওরম মহান ব্যক্তি হিসেবে দেখিনি। মানুষ হিসেবেই দেখি, যেটা আমার কাছে খুব বড় পাওয়া। তাই তাকে নিয়ে সিনেমা বানাতে সময় লাগল।'
সিনেমাটিতে অর্থায়ন করেছেন অঞ্জন নিজে এবং তার ছেলে নীল দত্ত। বিষয়টি নিয়ে বলেন, 'এটা মজার ছবি, আনন্দের ছবি। সবচেয়ে বড় কথা এই প্রথম একটা ছবি আমি ও আমার ছেলে নীল—আমরা দুজনে মিলে খরচা করে করেছি। কারো কাছে আমরা টাকা চাইনি। কারণ আমাদের মনে হয়েছে, এটা আমাদের মতো করে এভাবে কেউ করতে দেবে না।'
'চালচিত্র এখন' নির্মাণ নিয়ে অঞ্জনের ভাষ্য, 'আমি ছবিটা বানিয়েছি সিনেমাকে ভালোবেসে, আমার শহরকে ভালোবেসে। মৃণাল সেন আমাকে সিনেমা যা দিয়েছেন, আমার শহরটাকেও দিয়েছেন। আমাকে অনেক কিছু করতে শিখিয়েছেন। আমার মনে হয় এটা শুধু অঞ্জন দত্ত ও মৃণাল সেনের গল্প নয়। এটা দুটো জেনারেশনের গল্প। দুটো জেনারেশন যারা আলাদা, তারা ভিন্ন, কিন্তু তারা অনেকদিন একসঙ্গে চলতে পারে। জেনারেশন পেরিয়ে, বয়সের তফাত পেরিয়ে দুটো মানুষ কাছে আসতে পারে।
'আমরা চাইনি কোনো বায়োপিক করতে। আমরা চেয়েছিলাম যদি আজকের সময়ে মৃণাল দা বেঁচে থাকতেন এবং আজকে যদি আমি ২৪ বছর বয়সী হয়ে যেতাম, কীরকম হতো, এটাই। ভালোবাসা, নিজের শহরকে ভালোবাসা, নিজেকে ভালোবাসা, নিজেকে বোঝা, প্রশ্ন করা—এটাই ছবি।'
গত বছর কলকাতায় 'চালচিত্র এখন'র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। পুরস্কারও পায় সিনেমাটি। আজ ঢাকায় যে সিনেমাটি দেখানো হবে এবং সেখানে অঞ্জনও থাকবেন—এই খবর আগেই এসেছিল গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই কারণে সিনেমার প্রদর্শনীর সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মিলনায়তনস্থলে বাড়তে থাকে অঞ্জনভক্তদের ভিড়ও। মিলনায়তনের সব আসন পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় কেউ কেউ নিচে বসে, আবার কেউ কেউ পেছনে দাঁড়িয়েই দেখেন তাদের প্রিয় অঞ্জনের সিনেমা।
মৃণাল সেনকে কাছ থেকে দেখা, তার ভাবনা, বিশেষ করে 'চালচিত্রে'র তরুণ অঞ্জনের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে সিনেমার গল্পে। দেখা গেছে কীভাবে তরুণ অঞ্জন হয়ে উঠেছেন মৃণালের কাছের বন্ধু, পরিবারেরই একজন।
সিনেমার প্রদর্শনী শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন অঞ্জন দত্ত। বলেন, 'মৃণাল সেন না থাকলে আমি সিনেমার জগতে আসতাম না। আমি অনেক কিছুই করতাম না। আমি হারিয়ে যেতাম। কারণ ভারতে থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমার থিয়েটার করতে ভালো লাগত। আমি জার্মানি চলে যেতে চেয়েছিলাম। সিনেমাতে কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। বাংলা সিনেমা তো নয়ই। যেকোনো কারণেই তিনি (মৃণাল) আমার থিয়েটার দেখে আমাকে পছন্দ করলেন। তার সিনেমায় কাজ করালেন। তারপর একটা অনেকদিনের সম্পর্ক হয়।'
'আমি জার্মানি চলে যাই। কিন্তু আবার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসি। ফিরে এসে উনার সঙ্গে কাজ করতে, শিখতে শুরু করি। উনার সহকারী হই। অভিনেতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার... উনার একটা সিরিয়াল হয়েছিল, সেটার লাইন প্রডিউসার হই, টাকা জোগাড় করেছিলাম আমি। বাড়ির লোক হয়ে গেলাম। প্রায় উনার সন্তানের মতো, বন্ধু। মানে কী বলব আমি জানি না। এরকম অদ্ভূত একটা সম্পর্ক, ২৪ বছর বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে ৫৭ বছর বয়সী একটা মানুষের।'
'আমি সিনেমা বানিয়েছি, নাটক করেছি, গান লিখেছি। তিনি আমার গান পছন্দ করতেন। আমার অনেক কাজে আমি অনেক কিছুই এনেছি। আমার ছোটবেলা, আমার পরিবেশ, কলকাতার মিশ্রিত সমাজ, দার্জিলিং, আমার স্কুলের গল্প, আমার সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের গল্প, আমার চারপাশ, আমার পরিবার—সবকিছু নিয়ে আমি গান লিখেছি কিংবা এগুলো আমার সিনেমায় এসেছে। কিন্তু মৃণাল সেন আমার কোনো কাজে রিফ্লেক্ট হয়নি। কারণ তিনি এতটাই কাছের, তাই তাকে আমি দূর থেকে দেখতে পারিনি। দূর থেকে যদি দেখতে না পারি, তাহলে কোনো কাজ করা উচিত নয়।'
অঞ্জন দত্ত জানান, মৃণাল সেন বেঁচে থাকতেই তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এতে সায় দিয়ে মৃণাল বলেছিলেন, অঞ্জন যেভাবে তাকে কাছ থেকে দেখেছিলেন, সেটাই তুলে ধরতে। কিন্তু পরে শেষ অবদি তখন আর মৃণালকে নিয়ে কাজ করা হয়ে ওঠেনি, যা নিয়ে নিজের মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপও ছিল অঞ্জনের।
অবশেষে 'চালচিত্র' নির্মাণের ৪২ বছর পর এসে 'চালচিত্র এখন'র মধ্যে দিয়ে সেই আক্ষেপ হয়তো ঘোচালেন অঞ্জন। আর এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে কেবল রঞ্জনা, মালা, বেলা বোস কিংবা ম্যারি অ্যানের নয়, দর্শকরা প্রত্যক্ষ করছেন মৃণাল সেনের অঞ্জন দত্তকেও, পর্দায় যিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন 'মৃণাল সেন'।
Comments