বাংলাদেশ যেন আশির দশকের দক্ষিণ কোরিয়া

বাংলাদেশে বিনিয়োগ
জুনসেওক হান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮০ এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া রপ্তানিভিত্তিক শিল্পায়ন, কৌশলগত বিনিয়োগ ও ক্রমবর্ধমান দক্ষ শ্রমিকদের পরিচালনায় বৈশ্বিক পণ্য উত্পাদনের 'পাওয়ার হাউসে' পরিণত হয়েছিল।

প্রায় চার দশক পর বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক শ্রমশক্তি ও ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে।

নিজ দেশের এই পরিবর্তন নিজ চোখে দেখেছেন জিওর্দানো কোরিয়ার চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী জুনসেওক হান। তিনি এশিয়াজুড়ে পরিচিত।

বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে জুনসেওক হান নিজ দেশের সেইসব 'পরিচিত লক্ষণ' এখানে দেখে অভিভূত হয়েছেন।

সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনের এক ফাঁকে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি কয়েক দশক আগে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং কোরিয়ার প্রবৃদ্ধির মধ্যে তুলনা করে বলেন, 'এই দেশ আমাকে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে কোরিয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখানে বিশেষ করে উৎপাদন ও রপ্তানির অনেক সুযোগ আছে।'

হানের এই মন্তব্য এমন এক সময় এলো যখন বাংলাদেশের প্রতি কোরিয়ার আগ্রহ ক্রমাগত বাড়ছে। তার এই সফর বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশে কাঁচামালের উৎস খোঁজার পাশাপাশি কারখানা গড়ার পরিকল্পনার মাধ্যমে জিওর্দানো কোরিয়া বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

১৯৯৪ সালে হানের নেতৃত্বে জিওর্দানো কোরিয়ার পণ্য বিক্রি দুই বিলিয়ন ওন (দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা) থেকে পরের ছয় বছরে ১০০ গুণ বেড়েছিল।

২০০৩ সালের মধ্যে এটি কোরিয়ায় নারীদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোশাক ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।

এখন হান বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছেন। একে তার বৈশ্বিক যাত্রার পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে দেখছেন।

সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর হান বলেন, 'বাংলাদেশে এটি প্রথম সফর। আমাকে অবশ্যই বলতে হবে যে আমি ভীষণ মুগ্ধ।'

'উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, তরুণ পেশাজীবীসহ যোগ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেছি। তারা ব্যবসার চলমান বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ দেশের নেতৃত্ব শক্তিশালী ও দূরদর্শী। আমার বিশ্বাস, তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।'

হানের সফরটি উদীয়মান দেশগুলোয় কাঁচামাল ও উত্পাদিত পণ্য খোঁজার অংশ ছিল। ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান ক্রয় চুক্তির মতো বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি না হলেও দেশটি সেই ধারাতেই আছে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের আকর্ষণীয় দিক কোনটি তা জানতে চাওয়া হলে হান বলেন, 'এখানকার শ্রমশক্তি। আমি যাদের সঙ্গে দেখা করেছি—বিশেষ করে তরুণ পেশাদার ও কারখানার শ্রমিক—তারা দক্ষ ও সুশিক্ষিত। এটা বড় সম্পদ।'

তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকের দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, 'এটি এমন এক সময় যখন কোরিয়ার অর্থনীতি কৃষি থেকে শিল্পে বদলে যাচ্ছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি এখন বাংলাদেশকে একই সন্ধিক্ষণে দেখছি। শ্রমিকের মজুরি এখনো কম। এটি পণ্য উত্পাদন বাড়াতে সহযোগিতা করে।'

হান মনে করেন, 'শ্রমঘন খাতে এদেশের শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন পোশাক শিল্প, ইলেকট্রনিক্স অ্যাসেম্বলিং ও হালকা অটোমোটিভ যন্ত্রাংশ খাত বিকশিত হওয়ার সুযোগ আছে।'

আশাবাদ সত্ত্বেও, হান সংকটের কথাও বলতে ভুলেননি। বিশেষ করে, লজিস্টিক খাতের সংকট।

'পরিবহন ব্যবস্থা এখনো ভালো না। পণ্য সরবরাহে অনেক সময় লাগে। বন্দর ও জাহাজীকরণ অবকাঠামোয় দ্রুত মনোযোগ দেওয়া দরকার।'

'অবকাঠামোর দিকে নজর দিন। রপ্তানি প্রক্রিয়াগুলো সহজ ও পণ্য সরবরাহের সময় কমিয়ে আনুন। এগুলো করা হলে বিশাল পার্থক্য তৈরি হবে।'

হান নিশ্চিত করেন যে, জিওর্দানো কোরিয়া এখানে শুধু পর্যবেক্ষণের জন্য আসেনি। দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য দেশে রপ্তানির জন্য উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা গড়ার পরিকল্পনাও করছে।

'বর্তমানে আমরা বাংলাদেশ থেকে বছরে পাঁচ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকি। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তা তিনগুণ করার লক্ষ্য আছে।'

সম্প্রতি দেশের অন্যতম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ইয়াংওয়ান করপোরেশন পরিদর্শনে করে দৃঢ় সংকল্পের কথা জানান তিনি।

'ওদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রশংসনীয়। এটি আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে।'

বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, 'এখানে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা হয়েছে। সিউলে ফিরে আমি বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগের কৌশল নির্ধারণে উদ্যোগ নেব।'

'কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী। হুন্দাই, কেআইএ, স্যামসাং ও এলজি এখানে আছে। আরও অনেকে প্রতিষ্ঠান আসার চেষ্টা করছে। আশা করছি—দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশী কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।'

'এখানে অনেক সম্ভাবনা আছে,' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ যদি অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারে, আমার বিশ্বাস তারা নেতৃত্ব দেবে।'

তিনি জানান, দক্ষিণ কোরিয়ার ২৭ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী।

'ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের পথিকৃৎ ও কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের জন্য আদর্শ' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

5h ago