নগদ টাকার সংকটে ব্যবসায়ীরা

‘আমাকে মাত্র ১০ হাজার টাকা তোলার সুযোগ দেওয়া হয়। পারিবারিক প্রয়োজনে ৪০ হাজার টাকার দরকার বলে বারবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনুরোধ করি। তারা তা মানেননি। বাকি টাকা কীভাবে জোগাড় করব বুঝতে পারছি না।’
নগদ টাকার সংকটে ব্যবসায়ীরা
বুথ থেকে টাকা তুলতে না পেরে গ্রাহকরা ব্যাংকে ভিড় করছেন। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

নগদ টাকার অভাবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এক ধরনের সংকটে পড়েছেন। কারণ ব্যাংক থেকে দৈনিক নগদ টাকা তোলার সীমা বেঁধে দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গতকাল রোববার ব্যবসায়ীরা তাদের উদ্বেগের কথা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান।

গত শনিবার ব্যাংকগুলোকে বলা হয়, প্রতিটি অ্যাকাউন্ট থেকে দৈনিক দুই লাখ টাকার বেশি তোলা যাবে না। এই পরিমাণ বাড়ানোর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার দৈনিক নগদ এক লাখ টাকা তোলায় সীমিত করেছিল।

দীর্ঘ ১৫ বছর শাসনের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় ৪৫০ থানায় হামলা হয়। পুলিশ এখনো পুরোপুরি কাজে না ফেরায় নিরাপত্তার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকে নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক গ্রাহক তার প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা পাননি। কারণ নিরাপত্তার অভাবে নিয়মিত নগদ টাকা এটিএম বুথ ও ব্যাংকের শাখায় পাঠানো যাচ্ছে না।

ঢাকার দোহারের এক স্কুল শিক্ষক আক্ষেপ করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে মাত্র ১০ হাজার টাকা তোলার সুযোগ দেওয়া হয়। পারিবারিক প্রয়োজনে ৪০ হাজার টাকার দরকার বলে বারবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনুরোধ করি। তারা তা মানেননি। বাকি টাকা কীভাবে জোগাড় করব বুঝতে পারছি না।'

কয়েকজন ব্যবসায়ী ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন যে তারা হয়ত এই সপ্তাহ চলতে পারবেন। যদি নগদ টাকার সংকট বাড়তে থাকে এবং আগামী সপ্তাহেও বিধিনিষেধ চলতে থাকে তবে তারা আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বেন।

তারা আরও জানান, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে তাদের ব্যবসা বন্ধ।

ঢাকার অন্যতম বড় কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারের তেলের পাইকারি বিক্রেতা আবু বকর সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট সেখান থেকে এক লাখ টাকার বেশি তোলা যাচ্ছে না। বিষয়টা খুবই সমস্যার। ব্যবসা চালাতে সমস্যায় পড়ছি।'

তিনি জানান, বেশিরভাগ ব্যবসায়িক লেনদেন এখন ব্যাংক থেকে ব্যাংকে পাঠানো হচ্ছে।

পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সব ব্যবসায়ী চেক নেন না। অনেককে নগদ টাকা দিতে হয়। এখন লেনদেন কেবল ব্যাংক থেকে ব্যাংকে করা যাচ্ছে। চেকের মাধ্যমে দেওয়া যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি এই সমস্যার সমাধান হবে, ততই মঙ্গল।'

'ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকায় কাঁচামাল সরবরাহকারীদের টাকা দিতে সমস্যায় হচ্ছে। ছোট বিক্রেতা ও স্থানীয় ডিলারদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তাদেরকে নগদ টাকা দিতে হয়। টাকা তোলায় সীমাবদ্ধতা থাকায় নগদ অর্থের সংকটে ভুগছি।'

বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল হাশেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে পরিমাণ নগদ টাকা দরকার তা তুলতে পাচ্ছি না। এটা তো একটা বড় সমস্যা।'

আরেক বড় পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোববার আমার কারখানায় যে পরিমাণ টাকা পাঠানোর কথা ছিল, তা পাঠাতে পারিনি। আমার ১০ লাখ টাকা দরকার। পেয়েছি মাত্র দুই লাখ টাকা।'

তিনি আরও বলেন, 'যারা দিনভিত্তিক কাজ করেন তাদের পুরো টাকা দিতে পারছি না। আমি শ্রমিকদের এই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে বলেছি। কারণ এখন নগদ টাকা তোলার উপায় নেই।'

তার ভাষ্য, দিনভিত্তিক কাজ করা ব্যক্তিরা এখন খুব কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন।

'এটা তাদের জন্য অমানবিক। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে।'

ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকায় কাঁচামাল সরবরাহকারীদের টাকা দিতে সমস্যায় হচ্ছে। ছোট বিক্রেতা ও স্থানীয় ডিলারদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তাদেরকে নগদ টাকা দিতে হয়। টাকা তোলায় সীমাবদ্ধতা থাকায় নগদ অর্থের সংকটে ভুগছি।'

তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া, আমরা প্রতি সপ্তাহে ক্যাজুয়াল স্টাফদের নগদ টাকা দিই। তাই আমাদের প্রতিনিয়ত নগদ টাকা দরকার।'

তবে এটি স্বল্প সময় ধরে চললে তেমন সমস্যা হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে কিছু বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন যে তারা সমস্যায় পড়েছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'বেতন দেওয়ায় সমস্যা করা উচিত না। খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার মতো হঠাৎ খরচ বা অন্যান্য তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতেও সমস্যা হচ্ছে।'

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সিদ্ধান্তের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য টাকার সংকট তৈরি হয়েছে।'

এ বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নগদ টাকা তোলার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন।

পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মনে করেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন লেনদেন করাই ভালো।'

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনলাইন লেনদেনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে যে এটি নিরাপদ। এটি একটি ভালো দিক যে নিরাপত্তার স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমা আরোপ করেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যিনি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পান তার ব্যাংক বা বিকাশ অ্যাকাউন্ট নেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ধরনের কথা কেউ বললে তা অযৌক্তিক মনে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
economic challenges for interim government

The steep economic challenges that the interim government faces

It is crucial for the interim government to focus on setting a strong foundation for future changes.

8h ago