অর্থনীতির জন্য হতাশার একটি বছর
২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে করোনা মহামারি ও অন্যান্য বাহ্যিক চাপের ধাক্কা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা ছিল সবার।
কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে বছরব্যাপী দেশের প্রায় সব অর্থনৈতিক সূচক নিম্নমুখী ছিল। ফলে অর্থনীতি আশা অনুযায়ী ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
বছর জুড়ে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে বেশি কিছু উদ্বেগ ছিল। যেমন- মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, প্রত্যাশার চেয়ে কম প্রবাসী আয়, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি, নেতিবাচক আমদানি প্রবৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড খেলাপি ঋণ।
এছাড়া দুর্বল ইসলামী ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা ও তড়িঘড়ি একীভূতকরণের উদ্যোগ এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা গত অর্থবছরে দেশের আর্থিক খাতের সংকট আরও বাড়িয়েছে।
অর্থবছরের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি এসেছে হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিজ ও ফিচ থেকে। কারণ সংস্থা দুটি বাংলাদেশের রেটিং নিয়ে 'নেগেটিভ' পূর্বাভাস দিয়েছে।
গত বছরের মার্চ থেকে বাংলাদেশের ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ৯ শতাংশের বেশি ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতি এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ছিল না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ অধিকাংশ দেশ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে।
চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে, যা ২০২৪ অর্থবছরের জন্য সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কায় নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে কঠোর মুদ্রানীতি নিলেও বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা না থাকায় আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা পায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিলে সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে। তবে, ২০২৪ অর্থবছরের শুরুতে তা প্রত্যাহার করে ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের মুভিং অ্যাভারেজ রেটের ওপর ভিত্তি করে নতুন সুদের হার ব্যবস্থা চালু করে, যা সংক্ষেপে স্মার্ট নামে পরিচিত।
সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ব্যাংকগুলোকে বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে ধারাবাহিক উদ্যোগ নিতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা সত্ত্বেও রিজার্ভ বাড়েনি। আরও ২০২৪ অর্থবছর জুড়ে রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ ছিল।
এরপর ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নিরসন হবে।
কিন্তু আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ন্যূনতম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতেও ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার কমেছে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৬ জুন পর্যন্ত মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার।
এমনকি ডলার ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। তারপরও ডলার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বছর জুড়ে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা ছিল।
রপ্তানি নিয়েও কোনো ভালো খবর ছিল না, কারণ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি একপ্রকার শ্লথ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে আমদানি প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক ছিল।
অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল, ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এদিকে জুলাই-মে সময়ে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম দুটি উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে প্রবাসী আয় ১০ দশমিক ১০ শতাংশ বাড়লেও জনশক্তি রপ্তানির তুলনায় তা প্রত্যাশার চেয়ে কম।
সরকারি ও বেসরকারি বিনিময় হারের ব্যবধানও প্রবাসী আয় কমার একটি বড় কারণ। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ক্রলিং পেগ বিনিময় হার পদ্ধতি চালু করে বিনিময় হারে নমনীয়তা এনেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ অর্থবছর জুড়ে আর্থিক হিসাব নেগেটিভ অবস্থায় ছিল। অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে আর্থিক হিসাব ৯ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে
এছাড়া ২০২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে, যা দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে মন্দার ইঙ্গিত।
অন্যদিকে অর্থবছরের রেকর্ড খেলাপি ঋণ ও সংকটে থাকা ব্যাংকিং খাত এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তড়িঘড়ি ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ ও কিছু দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এ দুটিকে দায়ী করেছে।
এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার মতো বাহ্যিক কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়েছে।
শেষ কথা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অব্যবস্থাপনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন ও আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব দেশের অর্থনীতির জন্য হতাশাজনক।
Comments