শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে ইইউর নতুন আইন
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট অনুমোদিত নতুন সরবরাহ ব্যবস্থা আইন বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর শ্রম ও পরিবেশগত মান উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের ৬৪ শতাংশেরও বেশি পোশাক ইউরোপে রপ্তানি হয়।
গতকাল বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডাইরেক্টিভ (সিএসডিডিডি) পাস করে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ব্যবসার মান নির্ধারণ করবে। এর লক্ষ্য ইইউ এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশ ও মানবাধিকার সুরক্ষা বাড়ানো।
আইনটিতে এখন ইইউ সদস্য দেশগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রয়োজন। আগামী মে মাসে ইইউ মন্ত্রী পর্যায়ের ভোট হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রানা প্লাজা ভবন ধসে এক হাজার ১৩৮ পোশাক শ্রমিক নিহত ও দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হওয়ার ১১তম বার্ষিকীতে এই ভোট হয়।
২০৩০ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে কার্যকর হতে যাওয়া এই আইন রপ্তানি ও আমদানিকারকদের উত্পাদন, কমপ্লায়েন্স ও দায়িত্বশীল ব্যবসার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে।
কারণ, প্রথমবারের মতো সরবরাহ ব্যবস্থায় কমপ্লায়েন্স না মানার দায় আমদানিকারকদের নিতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক পোশাকের খুচরা বিক্রেতা ও যেসব ব্র্যান্ড রানা প্লাজার কারখানাগুলো থেকে পোশাক নিত, শ্রমিকদের মৃত্যুর জন্য তাদের দায়ী করা হয়নি। শুধু কারখানার মালিকদের দায়ী করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী আদমানিকাররা ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে আইনত বাধ্য ছিল না। তারা স্বেচ্ছায় এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন।
তবে, সিএসডিডিডি পাস হওয়া নিশ্চিত করে যে ইইউ যথাযথ উদ্যোগ নেবে এবং আমদানি ও রপ্তানিকারকদের দায়ী করবে।
বাংলাদেশে এই আইনের গুরুত্ব?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিএসডিডিডি মেনে চলার মতো অবস্থায় আছে। তবে, এমন কিছু ক্ষেত্র আছে গুণগতমান অর্জনের জন্য দেশকে উদ্যোগ নিতে হবে।
তবে বাংলাদেশকে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, সুশাসন ও পরিবেশ সুরক্ষাবিষয়ক চারটি মূল নীতিসহ জাতিসংঘের ৩২টি কনভেনশন অনুমোদন দিতে হবে।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সব মূল কনভেনশনের অনুমোদন দিয়েছে।
বাংলাদেশ এখনো কার্বন দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ রপ্তানিকারক কারখানা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। সিএসডি অনুসারে তাদের নবায়নযোগ্যযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানা ফকির অ্যাপারেলস লিমিটেডকে ইউরোপীয় ক্রেতারা ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন দূষণ ৫০ শতাংশ কমাতে বলেছে।
ফকির অ্যাপারেলসের চিফ অপারেটিং অফিসার বখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়ার প্রস্তুত হচ্ছি। তবে এর জন্য প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, 'ফকির অ্যাপারেলস বছরে ১৬০ মিলিয়ন ডলার পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করে। আইন অনুসারে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।'
বাংলাদেশে জীবনধারণের মতো প্রয়োজনীয় মজুরি চালু না হওয়ায় এবং শ্রম আইনের কঠোর শর্তের কারণে শ্রমিকরা এখনো কারখানায় ইউনিয়ন গড়তে সমস্যায় পড়ছেন।
বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ আইএলওর মূল কনভেনশন অনুমোদন করে শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে।'
তার মতে—মানসম্মত কাজের পরিবেশ, যৌথ দর কষাকষি ও মজুরির ক্ষেত্রে শিথিলতা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কারণ এগুলো নতুন আইনের মূল বিষয়।
রপ্তানি ও আমদানিকারক এবং শ্রমিকসহ সব পক্ষ যাতে সন্তুষ্ট হয় এবং শিল্পের ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করতে আইনটি ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি এবং প্রস্তুতি নেওয়ায় নতুন আইনের কারণে আমাদের ক্ষতি নাও হতে পারে।'
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'ক্রেতারা যদি রপ্তানিকারকদের পণ্যের যৌক্তিক মূল্য না দেন তাহলে আইন একতরফা এবং অকার্যকর হয়ে যাবে। এটি ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিবে।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার রক্ষা করা জরুরি। একইভাবে আমদানি ও রপ্তানিকারকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও দরকার।
তারা বলছেন, নতুন আইনের কঠোর প্রয়োগ বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে তা সব দেশে সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্পোরেট জবাবদিহিতাবিষয়ক সহযোগী পরিচালক অরুণা কাশ্যপ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, 'রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১১তম বার্ষিকী স্মরণ করিয়ে দেয় কেন যথাযথ আইন অনেকদিন থেকেই প্রয়োজন হয়ে আছে।'
'ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভোট যে কঠোর বার্তা দিচ্ছে তা হলো ইইউর উচিত বড় কর্পোরেশনগুলোকে মানবাধিকার ও পরিবেশ দূষণ থেকে বিরত রাখা,' যোগ করেন তিনি।
Comments