দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কম, কেন?
দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। তবুও বিদেশি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি।
শুধু ভারতের মতো বৈশ্বিক অর্থনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ দেশই নয়, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট অর্থনীতির দেশগুলোও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে।
ইউএনসিটিএডি'র ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে—দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের দিক থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার।
২০২২ সালে মালদ্বীপ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এটি দেশটির জিডিপির প্রায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই সময়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা পেয়েছে ৮৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এটি দেশটির জিডিপির এক দশমিক ২০ শতাংশ।
ডলারের হিসাবে বাংলাদেশ এই দুই প্রতিবেশীর তুলনায় বেশি বিদেশি বিনিয়োগ পেলেও জিডিপির শতাংশ হিসাবে উভয় দেশই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এফডিআই জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।
কিন্তু, ডলারের হিসাবেও এফডিআইয়ের পরিমাণ প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম।
'রূপকল্প ২০৪১' অনুযায়ী—২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে বার্ষিক জিডিপির এক দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পেতে হবে।
এ থেকে বোঝা যায়, গত দুই দশকে প্রায় ছয় শতাংশ বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বাংলাদেশ নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। গত দেড় দশক ধরে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য আইন হয়েছে। কিন্তু সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ আসেনি।
তাই প্রশ্ন জাগে—ভুল হচ্ছে কোথায়? প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ কেন কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ পেতে ব্যর্থ হচ্ছে?
বন্দরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো—পরিবহন ও লজিস্টিক সুবিধার পাশাপাশি কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সুযোগ যথেষ্ট নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সুযোগ-সুবিধাগুলো মূল্যায়ন করেন।
আরেকটি বিষয় হলো পলিসি ডিজাইন সংক্রান্ত।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের সাবেক প্রধান বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আখতার মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নীতি ও পরিচালন ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করার একটি বড় কারণ। নীতিগুলো ভালো হতে পারে। তবুও আমি বলব এখনো অনেক জায়গায় ফাঁক আছে।'
এফডিআই আকর্ষণসহ বিনিয়োগ পরিবেশ সংস্কারে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার তিন দশকের অভিজ্ঞতা আছে সৈয়দ আখতার মাহমুদের। তিনি মনে করেন, 'শুধু কাগজে-কলমে ভালো নীতি নিলেই হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বিচক্ষণ হতে হবে।'
তার মতে, নীতিমালা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয় সেটাই আসল পরীক্ষা। বাস্তবায়নে গরিমসি বা অত্যধিক বিবেচনামূলক সিদ্ধান্তগুলো অনিশ্চয়তা তৈরির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
তিনি বলেন, 'আমাদের মনে রাখতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেক বিকল্প আছে। তারা যদি আমাদের দেশকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় মনে না করেন, তাহলে অন্য দেশে চলে যাবেন।'
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম মাসরুর রিয়াজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এটি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।'
নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় লাগে। অন্যায্য সুবিধা পেতে বিরক্তিকর অজুহাত দেখানো হয়।
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ আনার ইচ্ছা আছে। তবে এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। বন্দর ও পরিবহন সুবিধার অভাব আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমস্যা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়ে গেছে।'
এ ছাড়াও, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিয়ে এফডিআই সুরক্ষা ও মুনাফা ফেরত পাঠাতে কার্যকর আইনের মাধ্যমে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
তারা সবকিছুই করেছে। যেমন, মালদ্বীপ পর্যটন খাতে মনোনিবেশ করেছে এবং শ্রীলঙ্কা পর্যটন, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
'বাংলাদেশে পরিবহন ও জ্বালানি সংকট এবং টেলিযোগাযোগসহ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলো সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ কেমন হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
একজন সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারী যাতে ঝামেলা ছাড়াই প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও সহায়তা পেতে পারেন সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দেশে বিনিয়োগকারী সহায়তা করার মনোভাবের অভাব আছে।'
বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা নিয়ে যেতে সমস্যায় পড়েন বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কর বিধিতে ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ধরে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর বিধির দাবি করে আসছেন।
তারা বিনিয়োগবান্ধব করনীতি প্রণয়নেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
গত বছরের নভেম্বরে 'ক্যাটালাইজিং গ্রেটার এফডিআই ফর ভিশন ২০৪১' শীর্ষক প্রকাশনায় ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) বলেছে, 'এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে করনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কর সংক্রান্ত বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক করনীতির তুলনায় বাংলাদেশের কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের অসামঞ্জস্য আছে।'
এফআইসিসিআই আরও বলেছে, 'অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায় যে, কর ব্যবস্থাকে আরও অনুকূল করা হলে রাজস্ব আয় ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব।'
এফআইসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যথাযথ আইনি ব্যবস্থার অভাব আছে। এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বড় বাধা।'
এফআইসিসিআইয়ের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সম্ভাবনা আছে। তবে এর জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় আইনি ও নীতিগত ব্যবস্থা নিতে হবে।'
তিনি মনে করেন, এত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে জনগণের বিপুল অর্থ খরচের প্রয়োজন নেই, এগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে।
বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় ইউটিলিটি সেবা ও নীতিমালার অভাবে সরকারি এলাকায় বিদেশি বিনিয়োগের গতি ধীর।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক এফডিআই কম আসার জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্থিতিশীল নীতিমালার অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।
এ ছাড়াও, অদক্ষতা ও জটিল শুল্ক ব্যবস্থার কারণে বন্দরে পণ্য খালাসের গতি কমে যায়। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগকারীদের এমন ঝামেলায় পড়তে হয় না।
দেশের ভাবমূর্তির কথা মাথায় রেখে কার্যকর নীতিমালার সঙ্গে নৈতিকতা ও সুশাসনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ আমিরুল হক। তিনি মনে করেন, এমনটি করা গেলে ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশেও দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
তিনি বিদেশি বিনিয়োগকে প্রত্যাশিত মাত্রায় আনার জন্য চারটি প্রস্তাব করেন।
প্রথমত, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা এমন নীতি নিচ্ছে না যা অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা হতে হবে কৌশলগত। যেমন, যদি রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ও অত্যাধুনিক খাতে বিনিয়োগ আনার পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে এমন খাতগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোয় বিনিয়োগকারীদের ডাকা উচিত।
তৃতীয়ত, যেসব বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাদের কাজের অগ্রগতির দিকে নজর রাখতে হবে।
পরিশেষে, যে বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে এখানে আছেন তাদের আরও যত্ন নিতে হবে।
Comments