বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির রপ্তানি আয়ের তথ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার গরমিল
বাংলাদেশে তথ্য-উপাত্তের অমিল থাকা নতুন কিছু নয়। কিন্তু, জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক আগে রপ্তানি জাহাজিকরণের তথ্য ও বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবধান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতো বড় ব্যবধান কোনো স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) চালানের পরিমাণের তথ্যে ব্যবধান ছিল ১২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার, যা অন্তত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, একই বছরে বাংলাদেশ ৫০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে।
আগেও ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের মধ্যে ব্যবধান দেখা গেছে। কিন্তু তা সাধারণত প্রায় ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ থাকত। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরে এই ব্যবধান ছিল ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও এই ব্যবধান বাড়ছে, যা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (বিওপি) বাণিজ্য ঋণের বিপুল অঙ্কের ঘাটতি থেকে অনুমিত হচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বাণিজ্য ঋণের ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঋণ রপ্তানিকারকরা রপ্তানির বিপরীতে অর্থ দেশে না আনলে তার তথ্য প্রতিফলিত হয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'অনেক প্রথাগত কারণে দুই সরকারি সংস্থার তৈরি তথ্যের মধ্যে ব্যবধান থাকে। কিন্তু, প্রথাগত কারণে এই বিশাল ব্যবধানের যৌক্তিকতা এখানে মেলে না।'
তিনি বলেন, নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কিছু মানুষ তাদের রপ্তানি আয় দেশে আনতে নাও পারেন।
এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের অস্থিতিশীলতা আরেকটি ধাক্কা। যেহেতু ঘন ঘন টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তাই রপ্তানিকারকরা মার্কিন ডলারের বিপরীতে আরও অবমূল্যায়নের আশায় দেশে রপ্তানি আয় ফেরত আনতে বিলম্ব করতে পারেন।
আবার যেহেতু রপ্তানিকারকরা বর্তমানে প্রকৃত হার পাচ্ছেন না, তাই কেউ কেউ অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের অর্থ আনতে পারেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আসছে না। ফলে, ইতোমধ্যে চাপে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও চাপের মুখে পড়ছে।
তিনি বলেন, 'এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত আছে। এ কারণেই বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বাণিজ্য ঋণে বিশাল ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, টাকার আরও অবমূল্যায়নের আশায় ও জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক রপ্তানিকারক অর্থ আনছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ কমেছে। এতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ণ হয়েছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে রপ্তানি আয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে এবং ব্যাংকগুলোকেও ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাংক ও ইপিবির তথ্যে সেবার পরিবর্তে পণ্য রপ্তানিতে বড় পার্থক্য দেখা গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য খাতে প্রকৃত ব্যবধান ছিল ১১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা খাতে শূন্য দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।
আগের বছরও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে ব্যবধান ছিল ৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা রপ্তানিতে শূন্য দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'সেবা খাতে তথ্য গোপন করা সহজ, কারণ কে কী রপ্তানি করছে তা জানার সুযোগ নেই। সুতরাং, এই সেক্টরে অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে, পণ্য রপ্তানির ফাঁকগুলো চিহ্নিত করা সহজ।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ তথ্য ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারছে না, তাই বছরের পর বছর পার্থক্য থেকে যাচ্ছে।'
'একসময় বাংলাদেশ দেশের বাণিজ্য তথ্য জাতিসংঘ কমট্রেডে রিপোর্ট করত, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রপ্তানির তথ্য যাচাই করার একটি উপায় ছিল,' যোগ করেন তিনি।
ইউএন কমট্রেড ১৯৬২ সাল থেকে প্রায় ২০০টি দেশ বা অঞ্চলের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট করা পণ্য ও পরিষেবার আমদানি-রপ্তানির বিশদ বিবরণ দিয়ে থাকে।
'কিন্তু ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ এতে অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং ২০১৫ সাল থেকে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তাই তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না এবং রপ্তানিকারকরা তাদের অর্থ সঠিকভাবে আনছে কি না তা কেউ কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে না,' বলেন তিনি।
তিনি জানান, বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নিয়ে আগেই মানুষ ধারণা করতে পারছে এবং রপ্তানিকারকরা টাকার আরও অবমূল্যায়নের আশা করছেন।
সুতরাং, 'তাই অনেকেই রপ্তানি আয় দেশে আনার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।'
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির দেওয়া তথ্যের মধ্যে সবসময়ই কিছু পার্থক্য থাকে।
'কিন্তু ১২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবধান অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। আসলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য সঠিক এবং আমরা ইপিবির তথ্যের সঙ্গে একমত নই,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, '১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় না এলে রপ্তানিকারকের নাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ড্যাশবোর্ডে প্রদর্শিত হয়। তারপর, রপ্তানিকারক ব্যাংক থেকে কোনো সেবা পান না। ব্যাংকিং সেবা অব্যাহত রাখতে রপ্তানিকারককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে মেয়াদ বাড়াতে হবে এবং রপ্তানিকারক যদি মনে করেন তিনি আয় পাবেন না, তাহলে অনুমোদনের আগে এটি বিশ্লেষণকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটিকে অবহিত করতে হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টিং সিস্টেমের মধ্যে পার্থক্য আছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, রপ্তানি আয় যখন দেশে আসে সেই হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রহণ করে। অন্যদিকে ইপিবি প্রাক-জাহাজিকরণের তথ্যেরি ভিত্তিতে রপ্তানি আয় হিসাব করে।
তিনি বলেন, 'পণ্য বন্দর ছাড়ার পর রপ্তানি আদেশ বাতিল হলে বা অন্য কোনো কারণে রপ্তানি আয় না এলে সেই তথ্য ইপিবির হিসাবে সমন্বয় করা হয় না। তাই পার্থক্য থেকে যায়।'
উচ্চ ব্যবধান নিয়ে তিনি বলেন, 'যেহেতু রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে, তাই পার্থক্যও বেড়েছে।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, চালান ও মূল অর্থ প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান নিয়ে সরকার ভালোভাবেই অবগত। এখানে কী ঘটছে তা দেখার জন্য ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
(প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)
Comments