রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়াবে

মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, অর্থবছর, আইএমএফ,
বাংলাদেশের একটি বাজারের সাধারণ দৃশ্য। স্টার ফাইল ফটো

বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সূচক চাপের মধ্যে আছে। জিনিসপত্রের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

দুই বছরের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং প্রতি মাসে রিজার্ভ কমছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে, আমদানি নির্ভর এই অর্থনীতির আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে।

এছাড়াও, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কমেছে। অন্যদিকে বিনিয়োগ একেবারেই নিম্ন স্তরে নেমে এসেছে।

দেশের সার্বিক অর্থনীতির এই অস্থিরতার পেছনে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামোও দায়ী বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এসবের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়বে অর্থনীতি আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় অর্থনৈতিক ইস্যুতে প্রাধান্য পায়, তাই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হলে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে না।'

গতকাল রাজধানীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর দেশে নতুন করে রাজনৈতিক শংকা দেখা দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে হরতালের কবলে পড়েছে দেশ।

এদিকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম এবং ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি প্রধান উৎস রপ্তানি আয় এসেছে ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি, কিন্তু গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

গত ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় চার মাসের আমদানি বিল মেটানোর জন্য যথেষ্ট। যদিও ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।

মার্কিন ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধের পরিমাণে নেমে আসবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের রাজনীতিবিদরা আপোস করতে চান না। তাদের এমন মনোভাব আদতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দিয়েছে।

'তাই বলা যায়, দুর্ভাগ্যজনক হলেও দেশ আরও রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে,' বলেন তিনি।

উদাহরণ টেনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না এবং ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে আগ্রহী হবে না।'

'এগুলো অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,' যোগ করেন তিনি।

ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক আগামী বছরের ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস শূন্য দশমিক ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো একটি গণতান্ত্রিক অধিকার।

তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। ফলে, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।'

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতির ধারাবাহিকতা ও নিরাপত্তাসহ একটি অনুকূল পরিবেশ চায়।

'আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে এটি সম্ভব হয়,' যোগ করেন তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম গত শনিবার সকালে ডেইলি স্টারকে বলেন, রাজনৈতিক সংকট এখনো অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেনি।

তিনি বলেন, 'কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে হরতাল ও অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে অর্থনৈতিক সমস্যা আরও প্রকট হবে।'

তিনি জানান, হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন অবস্থায় আছে।

তিনি বলেন, 'এর মাঝে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। তাই আমরা উদ্বিগ্ন। এখন একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন।'

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিএসইর লেনদেন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে ৭৯৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আস্থা ফিরে আসবে। ক্ষমতাসীন সরকারের উচিত বেশি ছাড় দিয়ে সমঝোতা করা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনা।'

আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, সংলাপ হলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, 'দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করা সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, যেন তাদের কর্মকাণ্ড অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে না পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

53m ago