চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে
রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধীর গতি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো সংবাদ নয়, বরং তা উদ্বেগজনক। কারণ, আগামী মাসগুলোতে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান দু্টি সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন না এলে দেশের অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলতি বছরের আগস্টে দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এটা ভালো হলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া রোধ করতে ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ঠিক রাখতে রপ্তানি আয় যতটা প্রয়োজন ততটা বাড়েনি।
আগস্টে প্রবাসীরা ১৫৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এটি গত ৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ছাড়াও, একই মাসে সামগ্রিক রেমিট্যান্স আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ কমেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে রপ্তানিতে এ প্রবৃদ্ধি খারাপ কিছু নয়। তবে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর যে চাপ পড়েছে তা কমাতে সহায়ক হবে না।'
২০২২-২৩ অর্থবছরের তথ্যে দেখা গেছে, সামগ্রিক আমদানি ১৬ শতাংশ কমায় বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি কমলেও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছর ছিল ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
এমন পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে দেশের রিজার্ভ কমছে। যেমন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালান্স অব পেমেন্ট-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী ৩১ জুলাই রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত ৩০ আগস্ট তা কমে ২৩ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থনীতিবিদরা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে একাধিক হারের পরিবর্তে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
গত সপ্তাহে, ব্যাংকগুলো একক হারে ডলার কেনা-বেচার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সেই বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হবে কি না তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে।
'ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে পার্থক্য আছে' উল্লেখ করে রাজ্জাক বলেন, 'খোলা বাজারে বিনিময় হার বেশি হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে না।'
তার মতে, 'ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হচ্ছে না। বরং খোলা বাজারে বিনিময় হার নির্ধারিত হলে তা রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হবে।'
টাকার মান আরও কমায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমদানি সীমিত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বরং, বাজারে পণ্য ঘাটতির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমদানি যদি বর্তমান গতিতে অব্যাহত থাকে এবং রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বিনিয়োগ না বাড়ে, তাহলে রিজার্ভ কমার ঝুঁকি বাড়তে পারে।'
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সর্বশেষ তথ্য 'উদ্বেগজনক' বলে মন্তব্য করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, 'এটা খুবই উদ্বেগজনক। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স অর্থনীতির দুটি প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু, রপ্তানির এত কম প্রবৃদ্ধি রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর জন্য যথেষ্ট হবে না।'
প্রতি মাসে রিজার্ভ কমছে, যদিও তা কমার হারও কমেছে। এভাবে চলতে থাকলে সামগ্রিক রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যেতে পারে।
অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, ব্যাংক ও খোলা বাজারের মধ্যে মুদ্রা বিনিময় হারে এখনো বড় পার্থক্য আছে। এ পার্থক্য অব্যাহত থাকলে রেমিট্যান্স বাড়বে না। সাধারণত যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশের বাইরে অর্থপাচারের প্রবণতা বেড়ে যায়। সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা কম।
তিনি বলেন, 'গত দেড় বছর ধরে অর্থনীতি যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে আছে তা মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের অনেক আগেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।'
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে 'ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফল' হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে কয়েকটি উদ্যোগ যথেষ্ট হবে না। তাই মনে হচ্ছে, অর্থনীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে।'
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্যানেল গঠনের সুপারিশ দেন অধ্যাপক রায়হান।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ইশতিয়াক বারী মনে করেন, 'রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাংক ও খোলা বাজারের মধ্যে মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবধান।'
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ করার পরও মুদ্রা বিনিময়ে সরকারি হার খোলা বাজারের হারের নিচে আছে।'
Comments