দেশে ১ বছরে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে ৮৭ শতাংশ

শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বাংলাদেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে যে ব্যর্থ তা এর মাধ্যমে ফুটে উঠে।

বাংলাদেশ গত ১ দশকে ৬ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। মোট জিডিপিতে শিল্পখাত, বিশেষ করে উৎপাদনখাতের অবদান বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কৃষি অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।

দক্ষ জনশক্তি, বিশেষ করে শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১২৮ বিদেশির ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন দেয়। এটি আগের বছরের তুলনায় ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি।

এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৯০ বিদেশি নতুন ও ৭ হাজার ৩৩৮ বিদেশি ওয়ার্ক পারমিটের নবায়ন চেয়েছেন বলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। কর্মীরা এসেছেন ১০৬ দেশ থেকে।

বিডা নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্প, বাণিজ্যিক কার্যালয় ও অন্যান্য সংস্থায় বিদেশিদের কাজের অনুমতি আছে।

বিদেশিদের তালিকায় শীর্ষে আছে রাশিয়া। ৩ হাজার ৯৬৬ রুশ নতুন ওয়ার্ক পারমিট বা পুরনো পারমিটের নবায়ন চেয়েছেন।

৩ হাজার ২১২ কর্মী নিয়ে ভারত দ্বিতীয় ও ২ হাজার ৩৪৬ কর্মী নিয়ে চীন তৃতীয় অবস্থানে আছে।

মস্কোর অর্থায়নে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রুশরা কাজ করছেন।

শিল্পখাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা মূলত শিল্পোন্নত বা উল্লেখযোগ্য শিল্পায়ন হয়েছে এমন দেশ থেকে এসেছেন।

যেমন—ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, তাইওয়ান ও জাপানের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ব্যবসার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এসব দেশের অনেক নাগরিক বাংলাদেশে দক্ষ কর্মীর চাহিদা মেটাচ্ছেন।

বিডা ছাড়াও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ও এনজিও ব্যুরোর মতো সরকারি সংস্থা ও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নানান প্রকল্পে বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হয়।

তবে ঠিক কতজনের ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন পেয়েছে তা জানা যায়নি। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেনি বিডা।

বিডার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্থানীয় শিল্পপতি ও পণ্য উৎপাদনকারীরা মূলত টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্ক পারমিট চান। গার্মেন্টস খাতের বায়িং হাউজগুলো প্রচুর সংখ্যক বিদেশিকে নিয়োগ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক সরবরাহকারী দেশ।

দেশের অন্যতম শীর্ষ টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এনভয় লিগ্যাসি বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে এর টেক্সটাইল ইউনিটে ৭ বিদেশি কাজ করছেন। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একজন বিদেশি এবং অন্যরা বিপণন ও পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করছেন।

এনভয় লিগ্যাসির চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশিদের নিয়োগ দিতে আমাদের প্রতিষ্ঠান আগ্রহী নয়। কারণ, তাদেরকে অনেক বেশি বেতন দিতে হয়।'

'তবে কারিগরি বিভাগে দক্ষ জনবল অপরিহার্য। স্থানীয়রা চাহিদা মেটাতে না পারায় আমরা বিদেশিদের নিয়োগ দিয়েছি,' যোগ করেন তিনি।

এনভয় লিগ্যাসি এর আগে ২৫ বিদেশিকে নিয়োগ দিয়েছিল।

মাহিন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ অভিযোগ করে বলেন, 'বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেকে চাকরির জন্য বিদেশে যান। তারা দেশের কারখানায় কাজ করতে আগ্রহী নন।'

'অন্যদিকে, দক্ষ বিদেশি কর্মীরা কারখানার আশেপাশে থাকেন। যখনই প্রয়োজন হয় তখনই তারা সেবা দেন,' যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আসিফ আশরাফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশে প্রচুর জনবল আছে। কিন্তু, দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব।'

তিনি আরও বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে যারা পাস করেছেন এবং যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক, উৎপাদন খাতে তাদের চাহিদা সবসময়ই বেশি থাকে।'

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ তরুণদের ভালো পারিশ্রমিক দিলেও তারা দীর্ঘদিন এখানে কাজ করেন না।'

সারা বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির সংকট আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অভিজ্ঞ কর্মীরাও উন্নত দেশের নাগরিক হচ্ছেন।'

বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এইচএম হাকিম আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে দক্ষ জনবলের অভাবে প্রায় সব ৫ তারা হোটেলেই বিদেশিদের মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান শেফের পদে নিয়োগ দিতে হয়।'

তার মতে, 'বাংলাদেশে দক্ষ জনবল তৈরি হয় না।'

গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর্মীদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি আছে।'

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ইস্যু করা পারমিটের চেয়ে বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।

তিনি বলেন, 'সরকার পরিচালিত প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিরা ওয়ার্ক পারমিট পান। এ ছাড়া, বিপুল সংখ্যক বিদেশি ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কাজ করতে আসেন। তাদের অনেকেই বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে গার্মেন্টস ও স্বাস্থ্যখাতে কাজ করছেন।'

স্থানীয়ভাবে দক্ষ কর্মী না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা বিদেশিদের নিয়োগ দেন। তার মতে, 'এতে দোষের কিছু নেই। তবে, সততার অভাব এখানে একটি সমস্যা। কারণ, তারা অনুমতি ছাড়াই কাজ করছেন।'

বিদেশিদের নিজ দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মনসুর বলেন, 'বহির্মুখী রেমিট্যান্স কয়েক বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে।'

'এটি একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা। আমরা যদি স্থানীয়ভাবে দক্ষ কর্মী খুঁজে না পাই তবে এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে,' উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বিদেশি পেশাজীবীদের বৈধভাবে কাজ করতে উৎসাহ দিতে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যুতে সরকারকে উদার হওয়ার আহ্বান জানান।

'এর ফলে আয়কর আদায়ের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব নিশ্চিত হবে।'

যেকোনো কালোবাজারি তৈরি হয় মূলত নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে। তিনি ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদনের সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কর আদায়ের পরামর্শও দেন।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus opens second round of talks to strengthen national unity

'Beautiful July Charter' would be unveiled following discussions, he says

1h ago