রেকর্ড ভর্তুকি বরাদ্দও যথেষ্ট নয়
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির উল্লেখযোগ্য মূল্যবৃদ্ধির পরও মন্ত্রণালয়ের দাবির মুখে সংশোধিত বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার রেকর্ড ভর্তুকি বরাদ্দ আরও ২৭ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বাড়ানো হবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি বৈঠকের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি নথি থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অবগত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, সরকার এই চাহিদার এক-তৃতীয়াংশেরও কম বরাদ্দ দিতে চায়।
এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা চাহিদার সবটুকু মেনে নেব না।'
কাজেই, এই অর্থবছরের জন্য মোট ভর্তুকি বরাদ্দ হবে ১ লাখ ১০ হাজার ১০৫ কোটি টাকা।
এই সিদ্ধান্ত এমন সময়ে আসলো, যখন ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ভর্তুকি ব্যয় কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফের কাছে তাদের অভিপ্রায়ের চিঠিতে বলেছেন, 'আমরা অগ্রাধিকারমূলক ব্যয়ের জন্য ভর্তুকিতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছি।'
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি দিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই খাতে আরও ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
বাজেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা এর জন্য আরও ৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।
চলতি অর্থবছরে কোনো ভর্তুকি না পাওয়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন গত বছরের আগস্টে রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির পরও জ্বালানি ভর্তুকি বাবদ ১৯ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার চাহিদা দিয়েছে।
সারে ভর্তুকি দিতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। এই খাতে আরও ৪০ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা প্রয়োজন।
বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ ৫ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও আরও ৪ হাজার কোটি টাকার চাহিদা দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের খোলা বাজারে বিক্রি কার্যক্রম পরিচালনায় ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দেওয়া হলেও আরও ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি, গ্যাস, সার ও পণ্যের দাম স্থিতিশীল হওয়ায় এবং জানুয়ারিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় এখন মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা খুঁজছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'বিপিসি এখন পেট্রোলিয়ামের দামে মুনাফা করছে, কিন্তু তাদের কিছু ভর্তুকি বকেয়া আছে। তারা সেই অর্থের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু, আমরা সেটা দেবো না।'
আইএমএফকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, উচ্চ বৈশ্বিক জ্বালানি মূল্যের কারণে বাজেটের চাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য বাজেট ভর্তুকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে তা তুলনামূলকভাবে জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে থাকা উচিত।
আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে সার ও খাদ্যের জন্য জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বর্ধিত ভর্তুকি প্রয়োজন হবে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, আগামীতে আমরা পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য সকল কাঠামোগত ভর্তুকি বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছি এবং এই লক্ষ্যে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ একটি পর্যায়ক্রমিক সূত্রভিত্তিক মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থায় চলে যাব৷ উপরন্তু, আমরা ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম আরও সমন্বয় করার বিষয়ে লক্ষ্য রাখব৷
জানুয়ারিতে ২ ধাপে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয়েছে এবং এখন থেকে প্রতি মাসে দাম 'সমন্বয়' করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
জানুয়ারিতেই শিল্পখাত, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্যাসের দামের খুচরা মূল্য ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই ৩ খাতে দেশের মোট ব্যবহৃত গ্যাসের ৭৮ শতাংশের চাহিদা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হবে। তাই সংশোধিত বাজেটে ২টি ওভারহেডের জন্য মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে।
কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে উভয় খাতের জন্য ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমানো হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
খাদ্য ও সারের জন্য আরও ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সরকারের ভর্তুকি পরিকল্পনার পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা কাকে ভর্তুকি দিচ্ছি, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।'
একটি স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাকে ভালো বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'তবে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়বে। সরকার তাদের জন্য কী করছে? সেই বিষয়ে সমাধান দরকার। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে অতিরিক্ত খরচের বোঝা তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।'
একইভাবে তিনি সার ভর্তুকি পুনর্মূল্যায়নেরও আহ্বান জানান।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'যদি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করার উদ্দেশ্যে সারে ভর্তুকি দেওয়ার হয়, তাহলে সাধারণ ভর্তুকি কখনই তুলে নেওয়া যাবে না। আমরা যদি সচ্ছলদের না দিয়ে শুধুমাত্র দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ভর্তুকি দিতে চাই, তাহলে ভর্তুকির বিষয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার।'
তিনি দরিদ্র কৃষকদের সারের দামে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য কার্ড পদ্ধতি প্রচলনের পরামর্শ দেন।
ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'এটা তো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, কম দামের কারণে ইউরিয়া ব্যবহার করে অন্য খাত লাভবান হয়।'
তিনি বলেন, 'সব ক্ষেত্রে সারের দামে ভর্তুকি দেওয়া কি ন্যায়সঙ্গত? সারে ভর্তুকি ন্যায়সঙ্গত ও পরিবেশবান্ধব হওয়া উচিত।'
Comments