উন্নয়নের মাশুল গুনছেন কৃষক
অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ইরি চাষ করতেন নুরুল ইসলাম। বছরের খোরাকি রেখে অতিরিক্ত ধান বিক্রি করতেন তিনি। গরুর জন্য ঘাসের চিন্তা করতে হতো না, ছিল বিস্তীর্ণ চারণভূমি। বর্ষায় বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালে মাছ ধরে দিব্যি বছর চলে যেত তার।
এখন এসব শুধুই অতীত। একসময়ের পুরোদস্তুর গৃহস্থ নুরুল ইসলাম এখন রিকশাচালক। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে কোনোমতে কাটছে দিন।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে 'বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল' (বিএসইজেড) বদলে দিয়েছে তার জীবনযাপন। স্থানীয়দের কাছে 'জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল' হিসেবে পরিচিত এই প্রকল্পের কারণে শুধু নুরুলের নয়, আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের বর্গাচাষিদের একই পরিণতি হয়েছে।
বিশেষ এই প্রকল্প তাদের পেশা বদলাতে বাধ্য করেছে। তাদের জীবিকার উৎস বিস্তীর্ণ আবাদি জমি, খাল ও অন্যান্য জলাশয় এই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করেছে সরকার।
আয়ের উৎস সীমিত হয়ে পড়ায় কৃষকদের কেউ এখন নুরুলের মতো রিকশাচালক, কেউ বা দিনমজুরের কাজ করছেন।
স্থানীয়রা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জমির মালিকদের মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। বর্গাচাষিদের ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, কর্মসংস্থানেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
হতাশাভরা কণ্ঠে মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বছরে ঘরে তোলা ধান নিজে খাওয়ার পর বাজারে বিক্রি করেছি। মাছ ধরেছি, সবজি ফলিয়েছি। গৃহস্থ কাজ তো স্বাধীন, নিজের মতো কাজ করতাম। এখন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা চালাই।'
পরিবেশবাদী ও স্থানীয়দের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ২০১৭ সালে 'বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল' (বিএসইজেড) নির্মাণের জন্য আড়াইহাজার উপজেলায় এক হাজার একর জমি নির্ধারণ করে।
গত বছরের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের পর এখন সেখানে বালু ভরাট, সীমানা প্রাচীর তৈরি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও গাছ লাগানোর প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চলছে।
এখন পর্যন্ত পাঁচটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান কারখানার জন্য বিএসইজেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করেছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানরে সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সালেহ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকল্পটি দুই ধাপে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ শেষ। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করছেন।'
সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে সেখানে নির্মাণকাজ চলতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানান, প্রকল্পের শ্রমিকরা এই এলাকার নন। তাদেরকে অন্য এলাকা থেকে আনা হয়েছে।
পরিবেশকর্মী ও স্থানীয়দের মতে, এই মেগাপ্রকল্প স্থানীয় পরিবেশ ও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যদিও বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশের অবক্ষয় এড়াতে তারা পরিকল্পিতভাবে কাজ করছেন।
নির্মাণ কাজ শুরুর আগে ২০১৮ সালে প্রকল্প এলাকা ও এর আশেপাশে সমীক্ষা চালানোর জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইকিউএমএস কনসাল্টিং লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয় বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ।
তাদের সমীক্ষায় বলা হয়, এই প্রকল্পের কারণে প্রায় এক হাজার ৭১৪ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের প্রায় ৬৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
'কথা রাখেনি বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ'
প্রকল্পের শুরুতে ওই এলাকার যেসব বর্গাচাষি অধিগ্রহণ করা জমি ও জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তাদের ও পরিবারের সদস্যদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ।
'আমাদের দেওয়া সেই কথা রাখা হয়নি,' বলে মন্তব্য করেছেন মাইজপাড়া গ্রামের অপর বাসিন্দা মো. জামান।
একই গ্রামের জাহিদুল মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কেউ বেকার থাকবে না—এমন আশ্বাস দিলেও প্রকল্প অঞ্চলে মাত্র কয়েকজনের কাজের সুযোগ হয়েছে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ পর্যন্ত গত এক দশকে আড়াইহাজার উপজেলায় প্রায় সাত হাজার ৪১৩ একর আবাদি জমিতে শিল্পায়ন হয়েছে। এই তালিকায় এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের আবাদি জমিও আছে।
'এত বিশাল পরিমাণ কৃষিজমির ক্ষতি উদ্বেগজনক,' উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রয়োজন আছে। কিন্তু কৃষিজমি, খাল ও জলাশয়ও অপরিহার্য। নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে কৃষকরা প্রকল্পের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা করা।'
বেজা কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে পুরোদমে কাজ শুরু হলে প্রায় এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন শুরু করলে ক্ষতিগ্রস্তরা চাকরি পাবেন। কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রকল্প এলাকায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পরিকল্পনা আছে।'
২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের সুবিধার্থে আশেপাশের খাল ও জলাশয়গুলো ভরাটের পর জলাবদ্ধতা ওই এলাকায় আরেকটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেওরাখালী খাল ভরাট করায় সেই এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা।
সম্প্রতি, মাইজপাড়ায় কয়েকটি বসতভিটায় পানি দেখা গেছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা মমতাজ বেগম (৫৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৃষ্টি হলে পুরো এলাকা ডুবে যায়। প্রতিবেশীর বাড়িতে যেতে হলেও অনেক পথ ঘুরে যেতে হয়। ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় বাঁশের সাঁকো।'
প্রকল্প পরিচালক সালেহ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকল্প এলাকায় চারটি খাল পুনঃখননের পরিকল্পনা আছে। রাস্তা ও ড্রেন তৈরি করা হবে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা কেটে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'কর্মীদের আবাসনের জন্য পর্যায়ক্রমে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
প্রকল্প এলাকার আশেপাশে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ তৈরির কাজ চলতে দেখা গেছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, অর্থনৈতিক অঞ্চলটিকে ঘিরে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন চলছে।
এ বিষয়ে বেজা চেয়ারম্যান হারুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিকল্পিত নগরায়নের বিষয়টি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে। প্রয়োজনে আমরা তাদের সহযোগিতা করব।'
Comments