বাংলাদেশকে ট্রানজিট করে ভারতে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের পরিকল্পনা সামিটের

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, বিটিআরসি, সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, সামিট, ভারতে ইন্টারনেট দেবে সামিট,

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ব্যান্ডউইথ সরবরাহে বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহারের আবেদন করেছে সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড। সামিটের আবেদনের পর সরকারের কাছে সম্মতি চেয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

জানা গেছে, গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে অনুমতি চেয়ে এই আবেদন করেছিল দেশের সবচেয়ে বড় ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক কোম্পানি সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড।

কিন্তু, দেশের বিদ্যমান আইনগুলো বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরের অপারেটরদের কাছে টেলিযোগাযোগ পরিষেবা ট্রানজিটের অনুমতি দেয় না। তাই বিটিআরসি এখন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চাইছে।

মূলত আন্তর্জাতিক টেরিস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) অপারেটর সামিট কমিউনিকেশনস ভারতী এয়ারটেলের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের পরিকল্পনা করছে।

আখাউড়া হয়ে আগরতলাকে কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করে সিঙ্গাপুর পৌঁছানোই এই সেবার মূল উদ্দেশ্য। এই সেবাটি একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি লিজড সার্কিট হিসেবে পরিচিত, যা ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করবে।

এর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

বিটিআরসির এক নথিতে বলা হয়েছে, তাদের কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রেজেন্টেশন পেশ করেছে সামিট কমিউনিকেশনস।

এতে বলা হয়েছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চেন্নাই হয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ওই রাজ্যগুলো সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত।

বর্তমানে দেশটির উত্তর-পূর্ব অংশ থেকে চেন্নাইয়ের ল্যান্ডিং স্টেশনে পৌঁছতে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এছাড়া, এই অঞ্চলের পাহাড়ি প্রকৃতির কারণে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন নেটওয়ার্ক স্থাপন তুলনামূলক কঠিন। অর্থাৎ, নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখা বেশ কঠিন কাজ।

অপটিক্যাল সিগন্যাল লেটেন্সি চেন্নাই দূরত্বে প্রায় ৫৫ মিলি সেকেন্ড পর্যন্ত প্রসারিত হয় এবং সিঙ্গাপুরে পৌঁছাতে ৮৭ মিলি সেকেন্ড পর্যন্ত যায়। নথিতে বলা হয়েছে, বর্তমান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত প্রায় ৮ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করায় ইন্টারনেট পরিষেবার খরচ বেড়ে যায়, একইসঙ্গে পরিষেবার মানও কমে যায়।

কম্পিউটার নেটওয়ার্কিংয়ে লেটেন্সি হলো- ডেটা প্যাকের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে যে পরিমাণ সময় লাগে।

সামিট কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আল ইসলাম বলেন, এতে ভারতে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি হবে।

'ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে কিছু ব্যান্ডউইথ বিক্রি করতে পারলে, রপ্তানির ভালো সুযোগ তৈরি হবে। আর টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল লাইসেন্স দিয়ে বৈধভাবে এই রপ্তানি করা সম্ভব,' বলেন তিনি।

তবে, কী পরিমাণ ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করা যাবে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে পারেননি আরিফ আল ইসলাম।

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসির (বিএসসিপিএলসি) ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে সামিট বিএসসিপিএলসির ব্যান্ডউইথ ও ভারতীয় ব্যান্ডউইথ উভয়ই সরবরাহ করতে পারে।'

এদিকে আইটিসি অপারেটরদের মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি ব্যান্ডউইথ আসে ভারত থেকে, এসব অপারেটররা মূলত স্থল সীমান্ত দিয়ে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে।

এ বিষয়ে দেশের জানতে চাইলে একটি ইন্টারনেট অপারেটরের এক শীর্ষ নির্বাহী বলেন, 'বাংলাদেশের ব্যান্ডউইথ চাহিদার একটি বড় অংশ ভারতীয় অপারেটররা পূরণ করে। সুতরাং, ভারতে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করা খারাপ আইডিয়া নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশও বিএসসিপিএলসির মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করে। কিন্তু বর্তমান নিয়মে আইটিসি অপারেটররা তা করতে পারে না।'

তার ভাষ্য, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো- কোনো বেসরকারি অপারেটরকে সুযোগ দেওয়া হলে ভারত থেকে আমদানি করা ব্যান্ডউইথ শেষ পর্যন্ত ভারতেই শেষ হয়ে যেতে পারে।

'এতে ভারতে বিএসসিপিএলসির ব্যান্ডউইথ রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে,' মন্তব্য করেন তিনি।

বর্তমানে বিএসসিপিএলসি আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিপিএল) মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসসিপিএলসির এক কর্মকর্তা বলেন, 'ভারতে আরও ব্যান্ডউইথ রপ্তানির সক্ষমতা আমাদের আছে।'

যেহেতু এ ধরনের ব্যান্ডউইথ ট্রানজিটের অনুমতি দেওয়ার কোনো আইনি বিধান দেশে নেই, তাই বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগ সামিটের প্রস্তাব মূল্যায়ন করছে এবং আইনি মতামত চেয়ে কমিশনের আইন ও লাইসেন্সিং বিভাগে একটি নোট পাঠিয়েছে।

নথিতে বিটিআরসি বলেছে, আইটিসির নির্দেশিকায় দেখা যায়- বাংলাদেশের গ্রাহকদের সেবা প্রদান এবং দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত করতে এ ধরনের লাইসেন্স চালু করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বাইরের গ্রাহকদের সেবা বা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহারের বিষয়ে কোনো বিধান উদ্ধৃত করা হয়নি উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, বিটিআরসি বা সরকার কেউই এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেয়নি।

এতে উল্লেখ করা হয়, সামিটের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ আছে। তাই সিদ্ধান্ত চেয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে বলে জানিয়েছে আইন ও লাইসেন্স বিভাগ।

এর আগে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ভারতী এয়ারটেল একই বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিল এবং মন্ত্রণালয় টেলিযোগাযোগ বিভাগকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে বলেছিল। তবে বিষয়টির কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সামিট কমিউনিকেশনসের প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।

টেলিকম বিশেষজ্ঞ ও এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পদক্ষেপ শুধু বর্তমান আইনি কাঠামোকেই দুর্বল করেনি, বরং উত্তর-পূর্ব ভারত এবং এর বাইরেও বাংলাদেশের ব্যান্ডউইথ রপ্তানির সম্ভাবনাকে দুর্বল করেছে।

লিরনেএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, 'এটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সরকারি অবকাঠামো, অপটিক্যাল ফাইবার জনগণের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে এবং একটি স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।'

'এটি বেছে বেছে বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়া উচিত নয়,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'এ ধরনের অনুমতি পুরো মন্ত্রিসভার অনুমোদনে নিতে হবে, বিটিআরসি বা টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে নয়।'

(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

5m ago