কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা পেয়েও ঘাটতিতে ৬ ব্যাংক
চারটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকসহ ছয়টি ব্যাংক বিশেষ তারল্য সহায়তা নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবের ঘাটতি রয়েছে।
ব্যাংকগুলো হলো—ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
এর মধ্যে কেবল ন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়া বাকি পাঁচটি ব্যাংকেরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের কাছে।
গত ৭ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে এই ছয় ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এরসঙ্গে তাদের নগদ রিজার্ভ অনুপাতে ঘাটতি বিবেচনা করা হলে মোট ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
সাধারণত পেমেন্ট সিস্টেমের জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি চলতি হিসাব পরিচালনা করতে হয় এবং এই অ্যাকাউন্টে একটি বড় অংকের টাকা রাখতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্লিয়ারিং প্ল্যাটফর্মে ওই ব্যাংকের লেনদেন সীমাবদ্ধ করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'তাদের চলতি হিসাবে টাকা কম থাকার অর্থ হচ্ছে, এই ব্যাংকগুলো গভীর সংকটে রয়েছে।'
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরেও তারা চলতি হিসাবের ঘাটতি পূরণ করতে পারেনি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যাংকগুলোকে তাদের চলতি হিসাবের ঘাটতির সমপরিমাণ বিশেষ তারল্য সহায়তা দিয়েছিল।
৭ আগস্ট পর্যন্ত এই ছয় ব্যাংকের কাছে বকেয়া তারল্য সহায়তা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা।
ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলতি হিসাব ঘাটতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম)। তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ চার আত্মীয় এই ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির ঘাটতি রয়েছে ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলমের জামাতা বেলাল আহমেদ। এই ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি রয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।
দুই হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা ঘাটতি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এই ব্যাংকের বোর্ড সদস্য রত্না দত্ত এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিকের স্ত্রী।
চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। তাদের ঘাটতি দুই হাজার ৯৭ কোটি টাকা। এস আলমের বোন হালিমা বেগম, ভাই ওসমান গনি ও মো. রাশেদুল আলম, রাশেদুলের স্ত্রী মার্জিনা শারমিন ও ভাগ্নে মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ আদিল ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে দুর্বল আর্থিক অবস্থায় থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক তাদের চলতি হিসাবে ৩৩৬ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ৩২ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের প্ল্যাটফর্ম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, 'কোনো ঋণদাতার চলতি হিসাবে কখনোই ঘাটতি রাখা উচিত না।'
তিনি জানান, চলতি হিসাবের ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকটিকে জরিমানা করা।
তিনি বলেন, 'জরিমানা না করে উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন তারল্য সহায়তা দেয়, তখন আমরা ধারণা করে নিতে পারি যে দেশের ব্যাংকিংখাত কোন দিকে যাচ্ছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তা জানান, যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্প সময়ের জন্য 'প্রমিসরি নোট'র বিপরীতে ব্যাংককে ঋণ দিতে পারে।
প্রমিসরি নোট হচ্ছে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি পত্র, যেখানে একটি পক্ষ অপর পক্ষকে একটি নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়। এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের নির্দেশে কোনো জামানত ছাড়াই ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
কয়েক মাস আগে ব্যাংকগুলোকে ক্রমাগত তারল্য সহায়তা দেওয়া বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে হচ্ছে জানতে চাইলে আবদুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গভর্নরের বিবেচনায় এটা দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'দেশের ব্যাংকিংখাতের স্বার্থে এই সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।'
Comments