সুদসহ জলবায়ু তহবিলের ৮২৭ কোটি টাকা আটকে আছে ফারমার্স ব্যাংকে

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের জমা করা ৫৩৮ কোটি টাকা সুদসহ ২০১৬ সালে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের। কিন্তু এর সাত বছর পর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৭৪ কোটি টাকা।

সহসাও এই অর্থ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিকে অর্থ ফেরত দিতে আরও আট বছর সময় দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। ফারমার্স ব্যাংক নাম পাল্টে বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক হিসেবে আছে।

গত ডিসেম্বরে হওয়া বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, আমানত ফেরত দিতে আরও ১৫ বছর সময় চাওয়া হলেও পরিবেশমন্ত্রী পদ্মা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ২০৩০ সালের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে বলেছেন।

সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, তারা এই অর্থ ২০১৫ সালে ফারমার্স ব্যাংকে এক বছরের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন। অর্থাৎ ২০১৬ সালে ব্যাংকটির এই অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা ছিল।

ব্যাংকটির মতিঝিল, গুলশান ও গুলশান অ্যাভিনিউ শাখায় এ টাকা জমা দেওয়া হয়।

এক কর্মকর্তা জানান, ৯ শতাংশ সুদসহ এখন ব্যাংকটির কাছে মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮২৭ কোটি টাকা।

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না পাওয়া ওই কর্মকর্তা বলেন, গত সাড়ে সাত বছরে ব্যাংকটি ৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০ বছরেরও বেশি সময় সময় নেওয়ার পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংক ও ট্রাস্টের সম্মতি অনুযায়ী ৯ শতাংশ সুদে নয়, ৬ শতাংশ সুদে অর্থ পরিশোধ করতে চায় ব্যাংকটি।

ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নুরুন নাহার হেনা ডেইলি স্টারকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরের বৈঠক শেষে ব্যাংকটির তাদের ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা এখনো সেই পরিকল্পনা জমা দেয়নি।

জাতীয় গণযোগাযোগ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নুরুন নাহার বলেন, 'আমানত জমা দেওয়ার এক বছর পর সুদসহ মোট অর্থ আমাদের ফেরত দেওয়ার কথা ছিল।'

ট্রাস্টের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক জয়নাল আবেদীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিজেদের বোর্ড সভা শেষে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবে। তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমাদের অবহিত করা হলে আমাদের মন্ত্রণালয় পরবর্তী করণীয় নিয়ে একটি সভা করবে।'

বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়সাল আহসান ডেইলি স্টারকে জানান, গত জুলাইয়ে তাদের বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়।

'আমরা আমাদের অঙ্গীকারে অটল রয়েছি যে, ব্যাংক যদি ভালো করে, তাহলে আমরা পাওনা পরিশোধ শুরু করব।'

গত ৩ আগস্ট পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে পদত্যাগ করা তারেক রিয়াজ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাওনা পরিশোধের জন্য আমরা ১৫ বছর সময় চেয়েছিলাম। সম্প্রতি আমরা ৫ কোটি টাকা দিয়েছি। ব্যাংকের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পেমেন্ট বাড়বে।'

'সম্প্রতি "গুজবের কারণে সংকট" দেখা দিয়েছে। যার ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকটির আমানত আগের বছরের তুলনায় ১৮৭ কোটি টাকা কমেছে', বলেন তিনি।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে ফারমার্স ব্যাংক কর্তৃক ঋণ বিতরণে ব্যাংকিং বিধিমালার চরম লঙ্ঘনের বিষয়টি দেখা যায়। ঋণ অনুমোদনে ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক পরিচালকদের জড়িত থাকার বিষয়টিও খুঁজে পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সাধারণ মানুষ তাদের আমানত উত্তোলনের করতে চাইলে ব্যাংকটির দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

২০১৬ সালে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এহসান খসরু। বিষয়টি নিয়ে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি জবাব দেননি।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই অর্থ যখন ফারমার্স ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়, তখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন কামাল উদ্দিন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ড. কামাল হোসেন জানান, ফারমার্স ব্যাংক সে সময় সর্বোচ্চ সুদের প্রস্তাব দেওয়ায় তারা টাকা সেখানে জমা দেন।

'আমার মেয়াদকালে আমি উচ্চ সুদের হার দেখে খুশি হয়েছিলাম। কারণ এর ফলে ট্রাস্ট বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিতে পেরেছিল। সেই সময় যদি আমরা সর্বোচ্চ সুদের হার থাকা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করতাম, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হত। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আমি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকেই সমস্যা শুরু হয়', বলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সাল থেকে তারা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ১৪টি চিঠি পাঠিয়েছেন এবং তাদের অর্থের বিষয়ে জানতে কয়েকবার বৈঠক করেছেন। কিন্তু ব্যাংকটির কাছ থেকে তারা কেবল আশ্বাস ছাড়া কিছুই পাননি।

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০ অনুযায়ী, ট্রাস্ট তার তহবিলের ৩৪ শতাংশ সুদ অর্জনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দিতে পারে, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়ার লক্ষে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করা যায়।

২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ট্রাস্ট সরকারি বরাদ্দ পেয়েছে ৩ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা।

বিষয়টি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জলবায়ু তহবিলের অর্থ কীসের ভিত্তিতে ও কার স্বার্থে ফারমার্স ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা অনুসন্ধানের জন্য সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।'

'২০১৮ সালে সংসদে যখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখন ইস্যুটি কেবল বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের জন্যই নয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্যও অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় ছিল। যদিও ট্রাস্ট বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অত্যন্ত বিতর্কিত এই বিনিয়োগের জন্য দায়ীদের জবাবদিহির কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সেই বিনিয়োগের বিকল্পও তো ছিল। ট্রাস্ট ও সরকার নিজেদের কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ব্যাংকটির কাছে জিম্মি করে রেখেছে এবং নজিরবিহীনভাবে অর্থ পরিশোধের মেয়াদ এত দীর্ঘায়ত করার সুযোগ দিয়ে উৎসাহিত করেছে', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

7h ago