ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ হতে পারে ৩ গুণ
গত ১৩ জুলাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হঠাৎ করে কমার পর আরও একটি ধাক্কার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতের আর্থিক চিত্র সামনে আসতে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ঝুঁকিতে থাকা সম্পদের প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের মধ্যে আছে শ্রেণিকৃত ঋণ, পুনঃতফসিল করা ঋণ, অবলোপন করা ঋণের পুনর্গঠিত অংশ ও আদালতের আদেশে শ্রেণিকৃত নয় এমন ঋণ। এই ৪ শ্রেণির ঋণই একটি ব্যাংকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং সেগুলোর যথাযথ প্রভিশন প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছরের জুনে বার্ষিক স্টাবিলিটি প্রকাশ করে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আগামীতে এই রিপোর্টে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তথ্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য রাজি হওয়া শর্ত অনুযায়ী এই চর্চাটি আবার শুরু করতে বলা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'আমাদের জানা মতে, করোনা মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা নীতিমালার মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। যেহেতু এই নীতিগুলো প্রত্যাহারের কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থার লোকসান ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে পারে। সম্পদের শ্রেণিকরণ, বিশেষ করে পুনর্গঠিত ঋণগুলোর কথা বর্তমান ব্যালেন্স শিটে সঠিকভাবে দেখানো উচিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তথ্য হিসাবে যুক্ত করা প্রয়োজন।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানা গেছে, ২০২২ সালের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করা হয়নি। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠিত খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য ঋণের তথ্য সংগ্রহ করছে, যা আদালতের আদেশে শ্রেণিকৃত করা হয়নি। পুনঃতফসিল করা ঋণের মোট পরিমাণও এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ১০ শতাংশই পুনঃতফসিল করা ঋণ থাকে। গত বছর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।
অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছিল। এরমধ্যে যে ঋণ পুনর্গঠন করা হবে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হিসাবে দেখাতে হবে বলে বাংলাদেশে ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
২০২২ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতের শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান দেখে বলা যায়, ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ৩ লাখ কোটি টাকার কম হবে না।
আদালতের আদেশে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি এমন ঋণের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা সময় সাপেক্ষ বিষয়। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর জন্য একটি বলপার্ক চিত্র ব্যবহার করবে, যাতে এটি আইএমএফ কর্মীদের পর্যালোচনার জন্য প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে।
আগামী অক্টোবরে এই কর্মসূচির প্রথম পর্যালোচনা হবে। তখন আইএমএফ স্টাফ টিম কর্মসূচির পরিমাণগত লক্ষ্যমাত্রা ও সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে। প্রায় ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলারের পরবর্তী কিস্তি ছাড় পারে কিনা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের জন্য নির্ধারিত ৬টি পরিমাণগত শর্তের মধ্যে ২টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পারবে না।
জুন শেষে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার ন্যূনতম মজুত ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, যা একটি বাধ্যতামূলক শর্ত। কিন্তু, সেই শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করতে পারবে না। কারণ, তখন নিট বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ২১ বিলিয়ন ডলারে কাছাকাছি ছিল বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে ন্যূনতম রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা যাচ্ছে না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল অন্তত ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায় করেছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। নন এনবিআর কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১৮ হাজার কোট টাকা। ৯ মাসে এনবিআর বহির্ভূত কর আদায় হয়েছে ৬ হাজার ১৪ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।
যদি শেষ ৩ মাসে পুরোটা আদায় করা যায় তবুও আইএমএফের যে টার্গেট আছে তা পূরণ হবে না।
বাজেট, সামাজিক ব্যয় ও উন্নয়ন মূলধন বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ অর্থের সর্বোচ্চ সীমার মতো বাকি পরিমাণগত লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ করা হয়েছিল।
জুনে সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে আছে সুদের হার করিডোর সিস্টেম গ্রহণ, আইএমএফের বিপিএম ৬ সংজ্ঞা অনুসারে অফিসিয়াল রিজার্ভ সম্পদের প্রতিবেদন ও বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার প্রবর্তন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি কর্মপরিকল্পনা সম্পন্ন ও ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা ছিল।
কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের জন্য কর রাজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ পেট্রোলিয়াম পণ্যগুলোর জন্য সরকারের পর্যায়ক্রমিক ফর্মুলা-ভিত্তিক মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ছিল। আশা করা যায়, এর আগেই তা চালু হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রৈমাসিক জিডিপি তথ্য প্রকাশ করার কথা ছিল এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা করা হবে।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ ও অর্থ কোম্পানি আইন ২০২০ এর খসড়া সংসদে জমা দেওয়ার কথা ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ ইতোমধ্যে সংসদে পাস হয়েছে।
যদি কোনো দেশ আইএমএফ কর্মসূচির অধীনে শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হয় তবে তাকে অবশ্যই এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। যদি আইএমএফ স্টাফ মিশন ব্যাখ্যাগুলো যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করে তবে তারা পরবর্তী কিস্তির অনুমোদন দিতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ২টি মূল লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতার জন্য সরকার দীর্ঘায়ত ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা কিছু সংস্কারের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবো। আমরা আশাবাদী যে, আইএমএফ স্টাফ মিশন আমাদের ছাড় দেবে।'
Comments