জীবন বদলে দিতে পারে জ্যাক মা’র জীবনের গল্প
চীনের সফল ব্যবসায়ী জ্যাক মাকে কে না চেনেন, তার সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। চীনের একটি দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা জ্যাক মা কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুবার ব্যর্থ হয়েছিলেন। আলিবাবার সফলতার আগে এই ব্যবসায়ী কয়েক ডজন চাকরি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি দমে যাননি, কখনো হাল ছাড়েননি। তাই সারা বিশ্বের তারুণ্যের কাছে একজন আইকন জ্যাক মা।
জ্যাক মা ওরফে মা ইউন ১৯৬৪ সালের ১৫ অক্টোবর চীনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের হাংঝুতে জন্মগ্রহণ করেন। তার একজন বড় ভাই ও ছোট বোন আছে। তিনি ও তার ভাইবোনরা এমন এক সময়ে বেড়ে ওঠেন যখন কমিউনিস্ট চীন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ওই সময় তার পরিবারের কাছে খুব বেশি অর্থ ছিল না।
তিনি প্রায়ই সহপাঠীদের সঙ্গে ঝগড়া করতেন। লিউ শিয়িং ও মার্থা এভারির বই 'আলিবাবা'তে তিনি বলেছেন, 'প্রতিপক্ষ যতই বড় হোক আমি কখনো ভয় পেতাম না'। তবুও, অন্যান্য শিশুদের মতো তার কিছু শখ ছিল।
১৯৭২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন হাংঝু সফরের পর তার শহরটি পর্যটনস্থলে পরিণত হয়। কিশোর বয়সে তিনি শহরের প্রধান হোটেলে ঘুরতে যেতেন। এর পেছনে ছিল জ্যাক মার ভিন্ন এক উদ্দেশ্য। এজন্য তিনি প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। মূলত ইংরেজি শেখার বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করতে ওই হোটেলের আশপাশে ঘুরতেন জ্যাক মা। একজন পর্যটকের সঙ্গে তার দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনিই তাকে 'জ্যাক' ডাকনাম দিয়েছিলেন।
কারণ তিনি জানতেন অর্থ বা যোগাযোগ ছাড়া তার এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো শিক্ষা।
হাইস্কুল শেষ করে জ্যাক মা কলেজে ভর্তির আবেদন করেন, কিন্তু দুবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ব্যর্থ হন। এরপর প্রচুর অধ্যায়ন করেন। অবশেষে তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় উত্তীর্ণ হন এবং হাংঝু টিচার্স ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। তিনি ১৯৮৮ সালে স্নাতক শেষ করেন। এবার শুরু হয় চাকরির লড়াই। তিনি যতবেশি সম্ভব চাকরির জন্য আবেদন করতে শুরু করেন।
ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের আগে তিনি কেএফসিসহ এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। অবশ্য শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব সাবলীল ছিলেন এবং নিজের কাজকে ভালোবাসতেন। যদিও তিনি মাসে মাত্র ১২ ডলার বেতন পেতেন।
কম্পিউটার বা কোডিং নিয়ে জ্যাক মা'র কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। তখন তিনি অনুবাদ ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং একটি চীনা কোম্পানির অর্থ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে ওই ভ্রমণ গিয়েছিলেন। তার প্রথম অনলাইনে সার্চ করা শব্দ ছিল 'বিয়ার'। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন ফলাফলে কোনো চীনা বিয়ার আসেনি। যা তাকে রীতিমতো অবাকই করেছিল। তখনই তিনি চীনের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে তার প্রথম দুটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। চার বছর পর তার অ্যাপার্টমেন্টে ১৭ জন বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানান। তাদের 'আলিবাবা' অনলাইন মার্কেটপ্লেসের জন্য বিনিয়োগ করতে রাজি করিয়েছিলেন। সাইটটিতে রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য পোস্ট করতে পারতেন, আর গ্রাহকরা সেখান থেকে সরাসরি কিনতে পারেন।
খুব দ্রুত ওয়েবসাইটটি সারা বিশ্বের মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরের মধ্যে কোম্পানিটি গোল্ডম্যান স্যাকস থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার ও সফটব্যাংক থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছিল। একবার কর্মীদের এক সমাবেশে মা বলেছিলেন, 'আমরা এটা করব, কারণ আমরা তরুণ ও কখনোই হাল ছেড়ে দিই না।'
আলিবাবাতে তিনি সবসময় মজা নিয়ে কাজ করতেন। যখন কোম্পানিটি প্রথম লাভজনক হয়ে ওঠে, তখন জ্যাক মা প্রতিটি কর্মচারীকে সিলি স্ট্রিংয়ের একটি করে ক্যান দিয়েছিলেন।
২০০৫ সালে ইয়াহু আলিবাবার প্রায় ৪০ শতাংশ শেয়ারের বিনিময়ে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। জ্যাক মা ২০১৩ সালে সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যানের পদে থেকে যান। ২০১৪ সালে জ্যাক মা সিএনবিসিকে বলেছিলেন, 'আজ আমরা যা পেয়েছি তা টাকা নয়। আমরা যা পেয়েছি তা হলো মানুষের বিশ্বাস।'
জ্যাক মা চীনের ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু, খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি এখনো বেশ বিনয়ী। তার বন্ধু জিয়াও-পিং চেন ইউএসএ টুডেকে বলেছিলেন, 'আমি মনে করি না, তার মধ্যে খুব পরিবর্তন হয়েছে। সে কুং ফু ফিকশন পড়তে ও লিখতে পছন্দ করে। এছাড়া সে পোকার খেলতে, ধ্যান করতে ও তাই চি অনুশীলন করতে পছন্দ করে। এমনকি তাই চি নিয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে কাজ করে।'
জ্যাক মা একজন পরিবেশপ্রেমী মানুষ। যখন তার স্ত্রীর পরিবারের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তিনি সন্দেহ করেছিলেন দূষণের কারণে হয়েছে। তিনি দ্য নেচার কনজারভেন্সির গ্লোবাল বোর্ডে বসেন এবং ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের একটি অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। তিনি চীনে ২৭ হাজার একর প্রকৃতি সংরক্ষণে অর্থায়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
জ্যাক মা সবসময় তার পারিবারিক জীবনকে স্পটলাইটের বাইরে রেখেছেন। আশির দশকের শেষের দিকে স্নাতক হওয়ার পরে তিনি ঝাং ইং নামের এক শিক্ষককে বিয়ে করেছিলেন। তাদের পরিচয় হয়েছিল স্কুলে। তার স্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'তিনি হয়তো সুদর্শন পুরুষ নন, তবে আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম। কারণ তিনি ব্যর্থতাকে কখনো ভয় পাননি।'
বিশ্বব্যাপী তরুণদের কাছে জ্যাক মা একজন সেলিব্রিটি। তার অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য শোনার জন্য প্রচুর মানুষ ভিড় করে।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, ইউএসএ টুডে, সিক্সটিন মিনিট, রয়টার্স,
Comments