বিল গেটস, জ্যাক মা ও ইলন মাস্কের সাফল্যের ‘৫ ঘণ্টা নীতি’

ছবি: সিইও ম্যাগাজিন

আপনি হয়তো দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কোনো সফলতা পাচ্ছেন না। ক্যারিয়ারের একটি স্থির অবস্থানে আটকে আছেন। সারাদিনের ক্লান্তিকর সব কাজের পর বাসায় ফিরে চাপ দূর করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন হাতে সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন। এটা মাঝে মাঝে হলে ঠিক আছে, কিন্তু প্রতিদিনকার ঘটনা হলে তা মোটেও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস নয়। 

এ কারণে বিশ্বের সবচেয়ে সফল ব্যক্তিরা তাদের অবসর সময় কাটান নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে।

প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে সময়ের সঠিক ব্যবহার হতে পারে আপনার সাফল্যের চাবিকাঠি। তবে, সাফল্যের চূড়ান্তে থাকা বিশ্বের বহু বিখ্যাত মানুষের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে, '৫ ঘণ্টা নীতি' বা 'ফাইভ-আওয়ারস রুল'। 

বিল গেটস, জ্যাক মা, ইলন মাস্ক, অপরাহ উইনফ্রে, মার্ক জাকারবার্গসহ অনেকেই তাদের সাফল্যের জন্য '৫ ঘণ্টা নীতি' অনুসরণ করেন। 

১৮ শতকে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এই নীতি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। ধারণাটি এমন ছিল, দিনে এক ঘণ্টা শেখার মাধ্যমে জ্ঞান বৃদ্ধি করা। ফ্র্যাঙ্কলিনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, ইম্প্যাক্টের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল সিমন্স, '৫ ঘণ্টা নীতি' প্রবর্তন করেন। 

থমাস কোরলি তার বই, 'রিচ হ্যাভিটস: দ্য ডেইলি সাকসেস হ্যাবিটস অব ওয়েলদি ইনডিভিজুয়্যাল'-এ ধনী ও সফল ব্যক্তিদের সাধারণ কিছু অভ্যাস তুলে ধরেন। তিনি ৫ বছর ধরে, ২০০-এরও বেশি সেলফ-মেড মিলিয়নিয়ারের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, তারা টিভি দেখেন না। তার পরিবর্তে ৮৬ শতাংশ দাবি করেছেন, তারা বই পড়েন। ৬৩ শতাংশ জানান, তারা সকালে যাতায়াতের সময় অডিওবুক শোনেন। 

প্রোডাক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ চনসে ম্যাডক্স বলেছেন, 'সফল ব্যক্তিরা যে পড়েন তা কোনো গোপন বিষয় নয়। সাধারণত একজন মিলিয়নিয়ার প্রতি মাসে ২ বা তার বেশি বই পড়েন।' তিনি সবাইকে পরামর্শ দেন 'অবসরের সময় ব্লগ, নিউজ সাইট, ফিকশন এবং নন-ফিকশন পড়তে। যাতে আরও বেশি জ্ঞান অর্জন করা যায়।' আর আপনি যদি প্রায়শই চলাফেরার মধ্যে থাকেন, তাহলে অডিওবুক বা পডকাস্ট শুনতে পারেন।

বিল গেটস দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, 'ছোট থেকেই, আমার শেখার অন্যতম প্রধান উপায় হলো বই পড়া।' বিল গেটস প্রতি বছর প্রায় ৫০টি বই পড়েন এবং তিনি একা নন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগকারীদের একজন হিসাবে প্রশংসিত ওয়ারেন বাফেট প্রতিদিন প্রায় ৬ ঘণ্টা বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন। যেখানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্করা দিনে মাত্র ২০ মিনিট পড়ার পেছনে ব্যয় করেন। 

বাফেট বলেন, 'জ্ঞান এইভাবে কাজ করে। এটি চক্রবৃদ্ধি সুদের মতো বাড়তে থাকে। আপনারা সবাই এটা করতে পারেন, কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনারা অনেকেই এটা করবেন না।' 

প্রেসিডেন্ট ওবামাও একমাত্র নেতা নন, যিনি তার সাফল্যের জন্য বই পড়াকে উল্লেখ করেছেন। 

হয়তো আপনি ভাবছেন, কার এত সময় আছে বই পড়ার মতো। সারাদিনের বিভিন্ন কাজের মাঝে সময় খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে, যদি বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসে থাকা অবস্থায় বই পড়ার জন্য সময় বের করতে পারেন, তাহলে আপনার কাছে কী অজুহাত আছে?

'৫ ঘণ্টা নীতি' যেভাবে কাজে লাগাবেন 

প্রতিদিন এক ঘণ্টা বা সপ্তাহে ৫ ঘণ্টা শেখা এবং অনুশীলনের জন্য বিনিয়োগ করুন। এর অর্থ হলো অন্যান্য কাজের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে, শেখা এবং উন্নতির জন্য আপনার সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য সময় আলাদা করা। এটা এতই সহজ।

যদিও বিভিন্ন কাজে আপনার সারা দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়, ফ্র্যাঙ্কলিন সেক্ষেত্রে দিন শুরু হওয়ার আগেই সকালে এক ঘণ্টা আলাদা করে নিতেন। যারা কর্মস্থলে যাতায়াতের ওপর থাকেন তারা অডিও বুক ও পডকাস্ট শুনতে পারেন বা যাত্রার মাঝে পড়তে পারেন। কিংবা, নিবেদিত শিক্ষণের জন্য আপনার দিনের শুরুতে এবং শেষে ৩০ মিনিট করে, এক ঘণ্টা আলাদা করে নিতে পারেন।

'৫ ঘণ্টা নীতির' ৩ অংশ

কৌশলটিকে ফলপ্রসূ করতে একে ৩টি অংশে ভাগ করা হয়। 

বই পড়া

পড়ার জন্য সময় ব্যয় করুন। অনেক সফল মানুষের অভ্যাস বই পড়া এবং কোনো কিছু শেখার জন্য একটি সহজ এবং সুবিধাজনক উপায় হলো বই পড়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিরা ফিকশন কম পড়েন, নন-ফিকশন, জীবনী এবং সংবাদ প্রতিবেদনের পাতা উল্টাতে বেশি সময় ব্যয় করেন। বর্তমানে ই-বুকের সহজপ্রাপ্যতার কারণে আপনি যেখানেই থাকেন না কেন যেকোনো বিষয়ে পড়তে পারবেন। 

আলিবাবার সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা বলেছেন, 'প্রচুর বই পড়ার ফলে কোনো বিষয়ে আপনি ভালো একটি সূচনা করতে পারবেন; যা প্রায়শই আপনার সহকর্মীরা পারবে না। যারা প্রচুর বই পড়েন তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জানার সম্ভাবনা বেশি।'

আপনি যদি প্রথমেই, প্রতিদিন এক ঘণ্টা বা তার বেশি পড়ার প্রতিশ্রুতি দিতে না পারেন। তাহলে, আগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট দিয়ে শুরু করতে পারেন।

ভাবুন

আপনার কাজের বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে সময় ব্যয় করুন। আপনি যা শিখলেন, আপনার চিন্তাভাবনা এবং ভুলগুলোর বিষয়ে চিন্তা করা বা ভাবতে শেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি হতে পারে কেবল দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবা বা আপনার চিন্তাভাবনাগুলোকে কোথাও লিখে ফেলা। 

২০১৪ সালে, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক বিশ্রাম ও চিন্তা করা শেখার ক্ষেত্রে সহায়ক। 

কোনো বিষয়ে না ভাবলে অনেক বেশি শেখার চেষ্টা আপনাকে বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারে এবং আপনাকে নতুন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে বাধা দিতে পারে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আপনার ভাবনার সময়টি যেন সুগঠিত হয়, না হলে আপনি বিভ্রান্ত হতে পারেন।

সব সময় একটি জার্নাল রাখার চেষ্টা করুন, আপনি যে বিষয়টি শিখছেন সে বিষয়ে ভাববার খোরাক যোগাবে। চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে অতীতে করা ভুল থেকে শেখার সুযোগ পাওয়া যায় এবং সেইসঙ্গে আপনি কোন কাজগুলো সঠিকভাবে করেছেন তাও মূল্যায়ন করা যায়।  

গবেষণা

আপনি যখন জ্ঞানার্জন করতে শুরু করলেন এবং ভুল করে বা কোনো বিষয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মধ্য দিয়ে চিন্তা করার প্রক্রিয়া অর্জন করলেন, তখন পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ হচ্ছে গবেষণা বা এক্সপেরিমেন্ট। এর মাধ্যমে আপনি দেখতে পারবেন কোনটি কাজ করছে এবং কোনটি করছে না; যা '৫ ঘণ্টা নীতির' একটি মৌলিক অংশ। এক্সপেরিমেন্ট এত কার্যকর হওয়ার কারণ হলো আপনার কাছে তখন তথ্য আছে, অনুমান নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন কিছু সমাধানের চেষ্টা আপনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আপনার নতুন আইডিয়াগুলো পরীক্ষার জন্য প্রতি সপ্তাহে কিছু সময় আলাদা করে রাখুন, এবার সেগুলো যতই উদ্ভট হোক না কেন। বিশ্বের সবচেয়ে সফল কিছু পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল স্বরূপ তৈরি হয়েছে।

বেনজামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এবং টমাস এডিসন তাদের পরীক্ষার কারণে শীর্ষস্থানীয় উদ্ভাবক এবং চিন্তাবিদ হয়ে ওঠেন। 

এ ক্ষেত্রে জ্যাক মা'র পরামর্শ হলো, আপনি যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করুন। যেমন: সহযোগিতা এবং দলগত কাজ সম্পর্কে একটি বই পড়ার পরে আপনি সেই জ্ঞান ব্যবহারের বা পরীক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিতে পারেন।

কয়েকটি লক্ষ্যণীয় বিষয়

আপনি যখন শেখার অভ্যাস তৈরি করবেন, তখন আপনি সম্ভবত আপনার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও সফল হবেন। বই পড়ার অভ্যাসে বিনিয়োগ, আপনাকে লাভবান করবেই। তবে, এ ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।

শেখার সঙ্গে কাজকে গুলিয়ে ফেলবেন না

শেখার সঙ্গে কাজকে গুলিয়ে ফেলা সহজ এবং এভাবেই আপনি আটকে যেতে পারেন। আপনি ভাবতে পারেন, সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করা আপনার উন্নতির জন্য যথেষ্ট, কিন্তু সেটি খুব কমই হয়। আপনি যখন প্রতিদিনের সমস্যাগুলোতে মনোনিবেশ করছেন, আপনি নিজেকে বিকাশ এবং বৃদ্ধির জন্য সময় দিচ্ছেন না। প্রতিদিন কাজ করতে গিয়ে কিছু শিখতে পারেন, এই আশার বিপরীতে ৫ ঘণ্টা নীতি ইচ্ছাকৃতভাবে শেখার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। 

শুধু প্রোডাক্টিভিটি নয়, উন্নতিতে মনোযোগ দিন

আপনি মনে করতে পারেন, আপনি যত বেশি প্রোডাক্টিভ, তত বেশি সফল হবেন। প্রোডাক্টিভিটি সাফল্যের জন্য ভূমিকা পালন করে বটে, কিন্তু শিক্ষা ছাড়া এটি অকার্যকর। আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদী আত্মউন্নয়নের পরিবর্তে, ক্রমাগত আপনার বর্তমান কাজের দিকে মনোনিবেশ করতে থাকেন, তাহলে আপনি জীবনে খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারনে না। 

সপ্তাহে '৫ ঘণ্টা নীতি' মেনে চলা বেশ কঠিন হতে পারে, কারণ এটি আপনাকে তাৎক্ষণিক কোনো ফলাফল এনে দেবে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আপনি এটিকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানবেন।

 

তথ্যসূত্র: দ্য সিইও ম্যাগাজিন, এন্ট্রাপ্রেনিউর.কম, লাইফ হ্যাক

গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি 
 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago