বেসরকারি বিনিয়োগ ৫ বছরে সবচেয়ে কম

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা হিসাবে বেসরকারি বিনিয়োগ দেশে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি ব্যবসায় আস্থাহীনতা বেড়ে যাওয়া ও কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সাময়িক তথ্য অনুসারে—চলতি অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আগের অর্থবছরে তা ছিল ২৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

এটি করোনা মহামারির সময় অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরের পর সবচেয়ে কম।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি বিনিয়োগ পরিবেশের প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতা।'

তিনি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও সরবরাহে অসামঞ্জস্যতা, ক্রমবর্ধমান আমদানি ও তারল্য সংকটে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর মতো ব্যবসায়িক পরিস্থিতির অবনতির দিকে ইঙ্গিত করেন।

ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১৬-১৭ শতাংশ করা হয়েছে। এটি ব্যবসার খরচ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ আরও বলেন, 'রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ব্যবসায়িক আস্থা আরও কমিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ও সেগুলোর ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।'

'এই সমস্যাগুলো কেবল ব্যক্তিগত ব্যবসায় নয়, পুরো অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।'

জ্বালানি খাত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও কাস্টমসের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে স্থিতিশীলতার আহ্বান জানান।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৮ দশমিক দুই শতাংশে উন্নীত করা।

সেই লক্ষ্য এখন ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে।

গত মার্চে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র সাত দশমিক ৫৭ শতাংশ। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বছরের প্রথমার্ধের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমে এক দশমিক আট বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা গেছে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক কমছে। কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য তা উদ্বেগজনক।'

তিনি আরও বলেন, 'বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সরকারের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। এটি সাত শতাংশের নিচে।' এই স্থবিরতা অর্থনৈতিক গতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ঋণের বাড়তি সুদহার এবং বিশেষ করে পণ্য সরবরাহ ও বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কারের ধীরগতির মতো বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছিলেন।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পিআই) চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, 'এটি কেবল পরিসংখ্যানগত পতন নয়, এটি দেশের আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তাকেই তুলে ধরে।'

তিনি মনে করেন, বেসরকারি বিনিয়োগ কাজের সুযোগ ও উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। তা না হলে টেকসই প্রবৃদ্ধি নাগালের বাইরে চলে যাবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিনিয়োগ কমে যাওয়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতার প্রতিফলন।'

তার মতে—ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, সুদের উচ্চ হার, ডলার স্বল্পতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেওয়ার মূল কারণ।

'বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত কমে যাওয়া এবং বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির মন্দা উদ্বেগের বিষয়,' বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এই ক্রমবর্ধমান জনশক্তিকে কাজে লাগাতে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।'

বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে কমে গেলে বেকারত্ব বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

Comments