৬৫ শতাংশ নিবন্ধিত করদাতা রিটার্ন দেন না, কেন?

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ কর। কিন্তু, দেশে করের আওতা বাড়াতে সরকারের নানান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আশঙ্কাজনক হারে ৬৫ শতাংশ যোগ্য করদাতা নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন দেননি।
অর্থাৎ, প্রতি তিন করদাতার মধ্যে এখনো দুইজনের আয়কর রিটার্ন জমা পড়েনি।
রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ১৪ লাখ টিআইএনধারী করদাতার মধ্যে ১৩ হাজার ৬৬ প্রতিষ্ঠানসহ ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার করদাতা রিটার্ন দাখিল করেছেন।
কর না দিলে রাজস্ব ঘাটতি হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর প্রশাসনের কার্যকারিতা কমে যায়।
গত এক দশকে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের দেশ।
নিবন্ধিত করদাতাদের উল্লেখযোগ্য অংশ রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হওয়ায় এর আরও নেতিবাচক দিক আছে।
সরকার প্রচুর পরিমাণ সম্ভাব্য রাজস্ব হারিয়েছে। এটি অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের খরচের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।
রিটার্নের বিপরীতে কর আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক দশমিক ৫৩ শতাংশ কমেছে। যদিও গত বছরের ১ জুলাই থেকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিটার্নের সংখ্যা বেড়েছে দেড় লাখ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্কসহ সার্বিক কর-রাজস্ব বার্ষিক চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ কম। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কর আদায় কমেছে প্রায় এক শতাংশ।
প্রত্যক্ষ করের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার প্রায়ই ভ্যাট ও পরোক্ষ কর বাড়িয়ে দেয়। এটি কম আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি বোঝা।
গত জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ১০ পণ্য-সেবা থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়।
অপর্যাপ্ত কর-রাজস্ব জনসেবা উন্নত করতে সরকারের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ প্রভাবিত হয়।
কর না দেওয়ার সংস্কৃতি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকেও নিরুৎসাহিত করতে পারে। একই সঙ্গে বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। টাকার হিসাবে পাওনা ১৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা হয়েছে। এটি সরকারি অর্থায়নের ওপর চাপ বাড়িয়েছে।
দেশে রিটার্ন দাখিলের হার কম হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে।
একটি বড় কারণ হলো সচেতনতা ও কর সম্পর্কে জানাশোনার অভাব। গ্রামে অনেকে কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানেন না।
এ ছাড়াও, রিটার্ন দাখিলের প্রক্রিয়াটি প্রায়শই জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে মনে করা হয়। তাই অনেকে কর দিতে চান না।
আইনের দুর্বল প্রয়োগ সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও কর আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় না। ফলে অনেকে রিটার্ন এড়িয়ে চলেন।
অবৈধ ব্যবসার ব্যাপকতাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক সম্ভাব্য করদাতা রিটার্ন দাখিলের প্রয়োজন বোধ করেন না।
তবে ই-রিটার্ন জমার হার ১৭৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ১৪ দশমিক ৩১ লাখে পৌঁছেছে।
এই পরিবর্তন ডিজিটাল ট্যাক্স দেওয়ার ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে।
করের টাকা খরচ সম্পর্কে জনগণের আস্থার অভাব আছে। অনেক করদাতা বিশ্বাস করেন, তাদের টাকা জনসাধারণের কল্যাণে খরচ হয় না।
এনবিআরের তথ্য বলছে—বর্তমানে প্রায় ৫১টি সেবা নিতে টিআইএন প্রয়োজন হয়। তাই অনেকে টিআইএন করলেও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না।
গত বছরের এক প্রতিবেদনে এনবিআর জানিয়েছিল, শুধু জমি হস্তান্তরের জন্য টিআইএন প্রয়োজন হওয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ টিআইএন করলেও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না।
এনবিআরের তথ্য আরও বলছে—ইতোমধ্যে দুই লাখের বেশি টিআইএনধারী মারা গেছেন। চাকরি ও অন্যান্য কারণে বিদেশে গেছেন প্রায় তিন লাখের বেশি টিআইএনধারী।
আরেকটি প্রধান কারণ হলো, করদাতাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব।
এ ছাড়াও, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের অধীনে দেশে প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠান আছে।
বিপুলসংখ্যক মানুষ ট্রেড লাইসেন্স পেতে টিআইএন করলেও পরে অনেক প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
এ সমস্যা সমাধানে এনবিআরকে রিটার্ন দাখিলের গুরুত্ব সম্পর্কে করদাতাদের জানাতে সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ানোর মতো জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।
কর দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করা ও ডিজিটাল ট্যাক্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও ব্যবহার উপযোগী করা হলে অনেকে কর দিতে আগ্রহী হতে পারেন।
কর না দিলে জরিমানা ও সময়মতো রিটার্নে প্রণোদনা দিলে কর আদায় বাড়তে পারে।
কর নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার এবং কর প্রণোদনার মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে আনুষ্ঠানিক করা হলে কর আদায় বাড়তে পারে।
রাজস্ব আদায় ও এর খরচ সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে কর ব্যবহারে স্বচ্ছতা বাড়ানো হলে কর ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরতে পারে।
টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নীতি সংস্কার, জনসচেতনতামূলক প্রচারণা ও প্রণোদনার মাধ্যমে এই সংকটগুলো মোকাবিলা করা জরুরি।
Comments