২০২৪-২৫ অর্থবছর

হিসাব করে খরচ করুন

নতুন বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া। নিত্যপণ্যের দাম কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ মানুষের আয় হয় আগের মতোই আছে অথবা কমেছে।
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে। এ বাজেটে সরকারের মূল ফোকাস থাকা উচিত রাজস্ব ব্যয় কমানো ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে।

সংকটে পড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে অর্থনীতিবিদরা মেগা প্রকল্পের খরচসহ সরকারি খরচ কমানো ও বাজেট বাস্তবায়নে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে, সাম্প্রতিক সময়ে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় কম আয়ের মানুষদের স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও প্রসারিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৪ শতাংশ এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার ১২ শতাংশের বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে কর আদায় বাড়ানো ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই।

নতুন বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া। নিত্যপণ্যের দাম কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ মানুষের আয় হয় আগের মতোই আছে অথবা কমেছে।

এদিকে সুদ ও টাকার বিনিময় হার বাড়ানো এবং দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস সংকটের কারণে বাড়তি উৎপাদন খরচ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা।

কিন্তু ভর্তুকি ও কর ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের উদারনীতিতেও লাগাম টানতে হবে। দেশ ইতোমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সংস্থাটি সরকারকে কর খরচ কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ তসলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারি প্রকল্পে এমনভাবে খরচ করা উচিত হবে না, যা ব্যয়ের তুলনায় আয় করতে পারবে না।'

গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।

একদিকে যেমন সরকারের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের রিজার্ভ কমছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার এখন রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

অধ্যাপক তসলিম মনে করেন, 'সবার আগে দুর্নীতি দমন করতে হবে। দুর্নীতি না কমালে বাড়তি কর জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে। জনগণের দুর্ভোগ বাড়লে কর-রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হবে না।'

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সমাধান লুকিয়ে আছে বলেও মনে করেন তিনি।

জনগণ ইতোমধ্যে যে পরিমাণ টাকা ঘুষ হিসেবে দিচ্ছেন তা যদি সরকার পায় এবং জনগণের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করা যায়, তাহলে সরকারের আয় অনেক বেড়ে যাবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাকের মতে, আগামী ছয় থেকে নয় মাস দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে সরকারকে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, 'সরকার যদি এটি যথাযথভাবে করতে পারে তবে "সফট ল্যান্ডিং" সহজ হবে। সরকারকে সরকারি খরচ কমাতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা কঠিন।'

সরকার যদি খরচ কমাতে না পারে, তাহলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়।

এম এ রাজ্জাক আরও বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। এখন নিত্যপণ্যের দাম কমাতে রাজস্ব নীতিকে এর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।'

তার মতে, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোকে ইতিবাচক করা যাবে না।'

২০২২-২৩ সালে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল নয় দশমিক শূন্য দুই শতাংশ, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর গড় ছয় শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ভোক্তা মূল্য সূচক গড়ে নয় দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। এটি আগের বছরের একই সময়ে ছিল আট দশমিক ৬৪ শতাংশ।

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রধান চ্যালেঞ্জ। কম ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। বাজেটে তা মোকাবিলা করা উচিত।'

তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ কমাতে সহায়ক সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতির আহ্বান জানিয়েছেন।

মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আরও টাকা বরাদ্দের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে কম ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর চাপ না বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের উদ্ভাবনী পথ খুঁজে বের করতে হবে।'

সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা, রিজার্ভ বাড়ানো এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তসলিম বলেন, 'ঋণনির্ভর উন্নয়ন নীতি সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে এবং মূল্যস্ফীতি একে আরও জটিল করে তুলেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এই উন্নয়ন নীতির কারণে ঋণের বোঝা ও সুদ পরিশোধের হার বেড়েছে। অর্থনীতি চাপে পড়ায় সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।'

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারিতে সুদ পরিশোধ ২৬ শতাংশ বেড়ে ৬০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

অধ্যাপক তসলিম বলেন, 'মূল্যস্ফীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ও অর্থ সরবরাহ কমাতে বাধ্য হয়েছে। এটি উত্পাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া দেশে আমদানি পণ্যের সরবরাহ সঙ্কুচিত করায় পণ্য যোগান কম হচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে।'

যেসব প্রকল্প বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো ছাড়া উন্নয়ন খরচও কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন এম এ রাজ্জাক।

গতকাল রোববার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, অংশীদাররা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রায়ই একে বাধাগ্রস্ত করে।

এ ছাড়াও, সরকারকে অবশ্যই খরচের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। জনগণের টাকা যথাযথভাবে খরচ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিষ্ঠানটির মনে করে, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সুশাসন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত।

Comments