উদ্বৃত্ত উৎপাদন সত্ত্বেও কেন বাড়ছে মাংসের দাম
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) দেশে মাংস উৎপাদনের উদ্বৃত্তের হিসাব দিলেও বাস্তবতা হলো, বাজারে মুরগি, খাসি ও গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। তাই মাংসের উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
ডিএলএসের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৭ দশমিক ১০ লাখ টন। তখন চাহিদা ছিল ৭৬ দশমিক শূন্য ৮ লাখ টন। অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত ছিল ১১ লাখ টন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মূল্য তালিকায় দেখা যায়, উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও গতকাল সোমবার ঢাকার ক্রেতাদের ব্রয়লার মুরগির মাংসের জন্য ১০ শতাংশ ও গরুর মাংসের দাম আগের বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ টাকা বেশি গুনতে হয়েছে।
ডিএলএস কর্মকর্তা, পোল্ট্রি ব্রিডার ও গরুর খামারির ডিএলএসের উদ্বৃত্ত উত্পাদনের তথ্যকে সমর্থন করলেও মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে তারা পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণকে দায়ী করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে যায়। আবার সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি হলে দাম বাড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ থাকলে দাম কমে যাওয়া স্বাভাবিক। এখানে হয় চাহিদাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, নয়তো সরবরাহকে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে চাহিদার পরিবর্তিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কয়েক ধরনের মুরগির রেসিপি থাকায় মুরগির মাংসের চাহিদা বেড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের প্রধান বাপন দে উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে ডিএলএসের তথ্যে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
তিনি বলেন, 'ডিএলএসের তথ্যের সত্যতা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। এই তথ্য ও বাস্তবতার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। এই তথ্য অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।'
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের ডিন সাজেদা আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের সংস্থাগুলোর হিসাব ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই উৎপাদন ও চাহিদার তথ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে।'
তার মতে, বেশি দাম বা দাম কমে যাওয়া শুধু উৎপাদন ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে না।
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআরওএ) মহাসচিব ইমরান হাসানও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
তিনি বলেন, 'চাহিদার তুলনায় মাংসের উৎপাদন বেশি হলে বাজারে এর প্রভাব পড়ত। দাম এখনকার চেয়ে কম হতে পারত। কিন্তু এটাই শেষ বাস্তবতা নয়।'
গতকাল ১ কেজি গরুর মাংস কিনতে ক্রেতাদের ৭৮০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। ২ বছর আগে এই দাম ছিল কেজিপ্রতি ৬০০ টাকা।
গরু ও খাসির মাংসের উচ্চমূল্যের এই পরিস্থিতিতে হোটেল মালিকরা চলতি সপ্তাহের শুরুতে বাজারে প্রাণিজ প্রোটিনের সরবরাহ ও বিক্রি বাড়াতে মাংস আমদানি সহজ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ এমরান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পশুখাদ্য, পরিবহন ও বিদ্যুতের খরচ বেড়েছে।'
তাই মাংস উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দাম বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'গত ১ বছরে প্রায় সব ফিডের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ। পরিবহন খরচ হয়েছে দ্বিগুণ।'
তার দাবি, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উৎপাদন খরচ কমে গেলে দামও আপনাআপনি কমে যাবে।
শীর্ষস্থানীয় পোল্ট্রি ব্রিডার ও ফিড মিলার প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, দেশে ব্রয়লার মুরগির মাংস উৎপাদনে উদ্বৃত্ত আছে। তবে, চাহিদা কমে যাওয়ায় জুলাইয়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কমেছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ ডেইলি স্টারকে জানান, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার মুরগির মাংসের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'গত এক বছরে খাদ্য, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের দাম বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক উৎপাদন খরচ ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।'
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতিদিন মাথাপিছু ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে।
ডিএলএসের পরিচালক (প্রশাসন) রিয়াজুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের মানুষ এখন প্রতিদিন গড়ে ১৪৮ গ্রাম মাংস খাচ্ছে।'
তিনি আরও জানান যে, তারা তাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উত্পাদনের হিসাব নির্ধারণ করেন।
মাংসের দাম বাড়ার পেছনে অনেক কারণ আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'গত ১ বছরে অন্যান্য পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে মাংসের দাম বাড়েনি।'
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে মাংস উৎপাদনের বিষয়ে ডিএলএসের দেওয়া তথ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা কঠিন।'
তিনি আরও বলেন, 'একদিকে উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে দাম বাড়ছে—এটা অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।'
'পারিবারিক আয়-ব্যয়ের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশে মাথাপিছু মাংস খাওয়ার হার খুবই কম,' যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিসংখ্যানগতভাবে এই তথ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা খুবই কঠিন।'
Comments