রিসাইকেল্ড সুতার বাজারে পিছিয়ে বাংলাদেশ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নতুন পরিবেশ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রিসাইকেল্ড অর্থাৎ পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতার ক্রমবর্ধমান বাজার ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। এ ধরনের সুতা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখনো অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে আছে।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা পুরনো বা ফেলে দেওয়া কাপড়, আসবাবপত্র ও পোশাক বা প্লাস্টিকের বোতলের মতো উপকরণ থেকে উত্পাদিত হয়।
পেটেন্ট করা রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাল্প বা তন্তু তৈরি করে সেগুলো থেকে সুতা করা হয়। কখনো কখনো এতে নতুন তুলাও ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বব্যাপী পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা থেকে তৈরি পোশাকের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ক্রেতাদের চাহিদায় পরিবর্তন আসছে।
এই পরিবর্তন প্রচলিত ফাস্ট ফ্যাশন ভাবনার দ্বারা আরও প্রভাবিত হয়েছে। কম টাকায় ফ্যাশনেবল পোশাক কেনার প্রবণতার কারণে পোশাকের চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে কার্বন নিঃসরণও হচ্ছে প্রচুর।
ক্রেতাদের এমন চাহিদার কারণে ইইউ পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা থেকে তৈরি পোশাক কেনার বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে।
ইইউ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের সব গার্মেন্টস পণ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা থেকে তৈরি হতে হবে।
নতুন আইনের অংশ হিসেবে সুইডিশ রিটেইল জায়ান্ট এইচঅ্যান্ডএম ২০২৫ সালের মধ্যে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা টেকসই উপকরণের ২৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কেনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা কিউওয়াই জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতার বার্ষিক বিক্রি ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৫৫৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৯ সালের মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদনকারী কারখানা আছে ৩টি। প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানাগুলো প্রতিদিন প্রায় ৪০ টন পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উত্পাদন করতে পারে।
আরও কয়েকটি কারখানায় ৬০ টন পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উত্পাদিত হলেও সেগুলো দেশের বাজারে গদি ও পর্দার কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
কয়েক কারখানা শুধু রপ্তানির জন্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদন করছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি নতুন সুতার দাম ৩ থেকে সাড়ে ৩ ডলার। সেখানে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতার দাম দেড় ডলার থেকে আড়াই ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
দেশে ৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আরও ৪টি প্রকল্প নির্মাণাধীন আছে। আগামী ১ বছরের মধ্যে এসব কারখানায় উৎপাদন শুরু হবে। তখন রপ্তানির উপযোগী পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতার দৈনিক উৎপাদন ১০০ টনে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একটি কারখানা স্থাপনের জন্য প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষ জনবলের অভাবে এই খাতে বিনিয়োগ খুব ধীর গতিতে আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কারখানায় প্রয়োজনের তুলনায় খুব অল্প পরিমাণে নতুন তুলা মিশ্রিত পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদন করছি।'
তিনি টেলিফোনে বলেন, 'গাজীপুরের মাওনায় আমাদের ডেডিকেটেড রিসাইকেলড সুতা মিল আগামী ৬ মাসের মধ্যে উৎপাদনে যাবে। সেখানে প্রতিদিন ৪০ টন ডেনিম সুতা উৎপাদিত হবে।'
ভালুকায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদনকারী কারখানা সরজ ফাইবার-টেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, বর্তমানে অনেক কারখানা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ থেকে সুতা উৎপাদন করছে।
স্থানীয়ভাবে 'ঝুট' হিসেবে পরিচিত ৭০ শতাংশ টুকরো কাপড়ের সঙ্গে ৩০ শতাংশ নতুন তুলা মিশিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা তৈরি করা হয়।
তিনি মনে করেন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদনে মূল্য সংযোজন প্রায় "৩০০ শতাংশে" পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪ লাখ টন কাপড় নষ্ট হয়। এর ৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে পুনর্ব্যবহার করা হয়।
অবশিষ্ট নষ্ট কাপড়ের একটি বড় অংশ রপ্তানি বা সুতা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বাকি কয়েক টন কাপড় মাটিতে মিশে যায়।
স্থানীয় কারখানা মালিকদের মতে—যদি ৩০ শতাংশ নষ্ট কাপড় পুনর্ব্যবহার করা যায়, তাহলে এটি নতুন তুলা আমদানি বাবদ ১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে।
ভালুকার সিমকো স্পিনিং অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রউফ ডেইলি স্টারকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় সম্প্রতি পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ থেকে তৈরি সুতার দাম কমেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুতা কেনার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট ও সুতা বিক্রিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এ খাতে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে।'
তার মতে, সরকারের উচিত শিগগির এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে ইইউভুক্ত কয়েকটি দেশের গবেষণা দলের সঙ্গে মিলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা তৈরির কাজ শুরু করেছি।'
'ভবিষ্যৎ ব্যবসা এ ধরনের সুতার ওপর নির্ভর করবে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, '২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।'
Comments