বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে ১৭ বছরে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বেড়েছে ৩ গুণ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিবিএস, উৎপাদন,
স্টার ফাইল ফটো

গত ১৭ বছরে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অংশ ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কিন্তু গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ।

২০০০ সালে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছিল। তবে, গত ২২ বছরে রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং গত বছর পোশাক রপ্তানি থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।

গত দুই দশকে পোশাক খাতের এই সম্প্রসারণের পেছনে কয়েকটি কারণ আছে এবং চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বেড়েছে।

পোশাক খাতের এই সম্প্রসারণের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে সম্প্রসারিত প্রাইমারি টেক্সটাইল খাত, যেখানে ইতোমধ্যে ২৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে।

ফলে, নিটওয়্যার সেগমেন্ট বর্তমানে দেশীয় বাজার থেকে ৯০ শতাংশেরও বেশি পোশাক ও সুতা পাওয়া যাচ্ছে।

একইভাবে, ওভেন রপ্তানিকারকরা স্থানীয়ভাবে ৪০ শতাংশেরও বেশি কাপড় সংগ্রহ করতে পারছেন। ঠিক একইভাবে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খাত দেশীয় বাজার থেকে তাদের চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে পারছে।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছে। যেমন- ২০০০ সালে বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে চীনের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, ২০০৫ সালে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া বাণিজ্যিক লড়াইয়ের কারণে ২০২২ সালে চীনের অংশ কমে হয়েছে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ।

সুতরাং, যখন বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব প্রসারিত হচ্ছে, তখন চীন তার দখল হারাচ্ছে।

আরেকটি আশার কথা হলো- তুলা ও মূলধনী যন্ত্রপাতির মতো কাঁচামালের ঘাটতি এবং জ্বালানি নিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আরও বেশি বাজার দখল করছে। বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী এবং বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, রপ্তানিকারকরা ভালো দামও পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, রপ্তানিকারকরা প্রতি ইউনিট গার্মেন্টস পণ্যে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি দাম পাচ্ছেন। হাই-এন্ড ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্যের ক্ষেত্রেও একই হারে দাম বেড়েছে।

প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক মনে করেন, বাণিজ্য যুদ্ধ ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্টিগ্রেশন ছাড়াও বাংলাদেশ প্রচুর দক্ষ জনশক্তি ও দক্ষ ব্যবস্থাপক গড়ে তুলেছে, উত্পাদনশীলতা বাড়িয়েছে, পণ্যের দ্রুত ডেলিভারি নিশ্চিত করেছে, গুণগত মান বাড়িয়েছে, পরিবেশবান্ধব কারখানা বাড়িয়েছে।

তিনি জানান, কোটা ব্যবস্থা বাতিল, ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকট, তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়া ও রাজনৈতিক সংকটের মতো বড় অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করেছে পোশাক খাত।

'এরপরও উদ্যোক্তাদের দৃঢ়তার কারণেই পোশাক খাতকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে,' বলেন তিনি।

এছাড়া, করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের পোশাক খাত ভালো করেছিল। কারণ, তখন প্রতিযোগী দেশগুলো পোশাক কারখানা বন্ধ রাখলেও বাংলাদেশের কারখানাগুলো বেশিরভাগ সময় চালু ছিল।

বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, গত ২০ বছরে বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েছে।

'একইভাবে, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কারণেও রপ্তানিকারকরা ভালো দাম পেয়েছেন,' বলেন তিনি।

ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল

রপ্তানিকারকরা বৈচিত্র্যময় পণ্যের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে অংশীদারিত্ব আরও বাড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা নতুন প্রজেক্ট, মার্কেটিং, ফ্যাশন ও ডিজাইনে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করছেন।

করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বাধা সত্ত্বেও অর্ডার বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অংশ ১০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্থানীয় রপ্তানিকারকরা জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো এশীয় বাজারগুলো ধরার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে এসব দেশের বাজারে রপ্তানি বাড়তে ‍শুরু করেছে এবং রপ্তানি ‍বৃদ্ধির আরও জায়গা আছে।

বাণিজ্য বিরোধের কারণে শুধু মার্কিন ক্রেতারা নয়, ইউরোপীয় ও জাপানের খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলোও চীন থেকে সরবরাহ কমাতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ১০০ ডলার মূল্যের জ্যাকেটের মতো উচ্চমানের পোশাক উৎপাদন শুরু করেছে, কয়েক বছর আগেও যা প্রায় অসম্ভব ছিল।

বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশকে অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। তবে স্থানীয় রপ্তানিকারকরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে গেছে এবং অন্যান্য বাজারেও একই সাফল্যের পুনরাবৃত্তির করতে চায়।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৫৩ শতাংশ বেড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। তবে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়কালে উচ্চ ভোক্তা মূল্যের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সরবরাহ প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে, চীনের কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিক্রি বাড়বে।

এদিকে, এশিয়ার বাজারে প্রবৃদ্ধি ও গার্মেন্টস পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় ও বাজার শেয়ার ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ।

এনভয় লিগ্যাসির চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধিতে তুলার দাম বড় ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শিপমেন্ট বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ।

পরিবেশবান্ধব পোশাক উৎপাদন কারখানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চ্যাম্পিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল কর্তৃক প্রত্যয়িত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশের আছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন মনে করেন, রপ্তানিকারকদের ১০ শতাংশ বাজার দখলের সক্ষমতা থাকলেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তা ৭ শতাংশ হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Neonatal mortality still high at 20 per 1,000 births

A recent study has raised concerns about their current condition, revealing operational issues that could threaten future progress.

13h ago