করমুক্ত আয়সীমা বেড়ে হতে পারে পৌনে ৪ লাখ

আসন্ন জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের ওপর করের চাপ কমাতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো ও নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম শিথিলসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ব্যক্তি করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে পৌনে চার লাখ টাকা করার কথা ভাবছে।
প্রস্তাবটি আগামী ১৫ মে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর ১৯ মে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রস্তাবনাটি উপস্থাপন করা হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে।
অর্থ উপদেষ্টা আগামী ২ জুন বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েক বছরে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যক্তিপর্যায়ে কিছুটা স্বস্তি দিতে এসব ব্যবস্থা বিবেচনা করা হচ্ছে।'
গত ২৬ মাস ধরে বাংলাদেশে নয় শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় ব্যাপকভাবে কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল নয় দশমিক ১৭ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে।
চলমান জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট বিবেচনায় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বারবার করমুক্ত আয়সীমা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
গত মার্চে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) করমুক্ত আয়সীমা আরও ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করে। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এই সীমা সাড়ে চার লাখ টাকা করার অনুরোধ জানায়।
অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর বক্তব্যেও একই। তাদের মতে, বর্তমান করমুক্ত আয়সীমা অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নেই।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা শিথিল করার কথাও ভাবছে সরকার।
বর্তমানে কোনো ব্যক্তি সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে আগের অর্থবছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়।
কর্মকর্তাদের মতে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের বিনিয়োগ সহজ করতে এই বিনিয়োগ সীমা দ্বিগুণ করে ১০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ৪৫টি সরকারি ও বেসরকারি সেবার জন্য রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়।
ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স বাড়ানোর লক্ষ্যে এনবিআর এই ৪৫টি সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করে।
তবে প্রস্তাবিত পরিবর্তনের আওতায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রথমবার লাইসেন্স নেওয়ার সময় রিটার্নের প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হতে পারে। তবে, নবায়নের সময় রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলকই থাকতে পারে।
আসন্ন বাজেটে সরকার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর ছাড় বা হ্রাসকৃত হার বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। কারণ, আইএমএফের চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তির শর্ত ও রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবেই সরকার সেটি করতে পারবে না।
রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, করছাড় ধাপে ধাপে বাতিল করা হবে। কিছু ছাড় স্বাভাবিক মেয়াদের পর শেষ হয়ে যাবে। আবার কিছু ছাড় আইনগত আদেশের মাধ্যমে কমিয়ে আনা হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে টেক্সটাইল রপ্তানিকারকদের দেওয়া করছাড় চলতি বছরের জুনে শেষ হবে এবং সেটি নবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে প্রস্তুত পোশাক খাত 'সানসেট ক্লজ'র আওতায় ২০২৮ পর্যন্ত হ্রাসকৃত করহার উপভোগ করতে পারবে।
বর্তমানে পাট, ছোট টেক্সটাইল মিল, পোলট্রি ও মৎস্য খাত যেসব হ্রাসকৃত করহার উপভোগ করছে, সেগুলো ধীরে ধীরে বাড়ানো হতে পারে। এগুলোর বর্তমান করহার পাঁচ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন করমুক্ত আয়সীমা ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'আমরা এই সীমা চার লাখ টাকা করার সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে এটি অন্তত একটি ইতিবাচক উদ্যোগ।'
তবে তিনি সরকারের রাজস্ব সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে করজাল সম্প্রসারণ ও কর ফাঁকি কমানোর বিষয়ে কাজ করার ওপর জোর দেন।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে অনলাইনে প্রায় ১৬ লাখ করদাতা রিটার্ন দাখিল করেছেন।
তবে তাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শূন্য রিটার্ন জমা দিয়েছেন, আর প্রায় ৬৫ শতাংশ টিআইএনধারী কোনো রিটার্ন জমা দেননি। দেশে মোট টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১৩ লাখ।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'অনেকেই কর দেওয়া বিষয়টি এড়িয়ে যান। সেটা উদাসীনতা থেকেও হয়, আবার কখনো কর ফাঁকির প্রবণতা থেকেও হয়। অনেকে আবার ভাবেন, তাদের টাকা সরকার ঠিকভাবে ব্যবহার করছে, নাকি অপচয় হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'এই কারণে করদাতাদের উদাসীনতা দূর করতে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনসম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং বিনিময়ে দৃশ্যমান ও মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা।'
Comments