নিউইয়র্কে ‘স্বাধীনতার রঙ’ ছড়াবেন দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পীরা
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে চারুশিল্পীদের অবদান ছিল অপরিসীম। সে সময় শিল্পীসমাজ প্রগতিশীল ছাত্র ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার পাশাপাশি পোস্টার, ব্যানার, মঞ্চসজ্জা, পেছনের দৃশ্যপট আঁকার কাজসহ বিভিন্নভাবে অবদান রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতে 'বাংলাদেশের শিল্পীদের চিত্র ও অঙ্কন প্রদর্শনী ১৯৭১' শিরোনামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল তহবিল গঠনের পাশাপাশি বিশ্ববিবেকের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরা। বহির্বিশ্বের কাছে সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করা। ওই প্রদর্শনীতে ১৬ জন শিল্পীর ৬৫টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়।
এবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে 'স্বাধীনতার রঙ' ছড়াতে যাচ্ছেন দেশের বরেণ্য ও প্রথিতযশা চিত্রশিল্পীরা। সেখানকার 'গ্যালারি ওয়ান'-এ দেশের খ্যাতিমান ২৫ জন শিল্পী ও প্রবাসে অবস্থানরত ২৫ জন বাংলাদেশি চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে 'কালারস অব ফ্রিডম' শিরোনামের সপ্তাহব্যাপী এক প্রদর্শনী।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইবিটিভি ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত কালারস বিজনেস ম্যাগাজিনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামসের এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করার কথা আছে। প্রদর্শনীটি কিউরেট করবেন জিয়াউল করিম।
বাংলাদেশের যেসব খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীর কাজ এই প্রদর্শনীতে স্থান পেতে যাচ্ছে তাদের নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা ক্লাবে এক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন আয়োজকরা। এসব শিল্পীদের পাশাপাশি ওই নৈশভোজে অংশ নেন গণমাধ্যম-অভিনয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতি মানুষেরা।
তাদের সবাই নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় এই প্রদর্শনীকে বাংলাদেশের শিল্পীদের চিত্রকর্ম বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। সেইসঙ্গে তাদের ধারণা, এমন একটি উদ্যোগের মাধ্যমে সেখানকার চিত্রশিল্পীদের কাজ সম্পর্কেও একটি সম্যক ধারণা পাবেন এখানকার শিল্পীরা, যা হবে এ বিষয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি মাধ্যমও।
আয়োজকদের দেওয়া তালিকা অনুসারে প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের যে শিল্পীদের চিত্রকর্ম কাজ স্থান পেতে যাচ্ছে তারা হলেন- শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, আবদুস শাকুর শাহ, বীরেন সোম, হামিদুজ্জামান খান, আবুল বারক আলভী, আবদুল মান্নান, আফজাল হোসেন, ফরিদা জামান, মোহাম্মদ ইউনুস, জামিল আহমেদ, নিসার হোসেন, শামসুদ্দোহা, রেজাউন নবী, শেখ আফজাল হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য, কনকচাঁপা চাকমা, মোহাম্মদ ইকবাল, লায়লা শারমিন, মো. মুনিরুজ্জামান ও মো. জহির উদ্দিন।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান আইবিটিভি ইউএসএ'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এবং কালারস বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রকাশক জাকারিয়া মাসুদ জিকো সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রদর্শনীর পর পর্যায়ক্রমে দেশের তরুণ শিল্পীদের কাজ নিয়ে একই ধরনের প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনার কথা জানান।
গতকালের নৈশভোজে এই প্রদর্শনী নিয়ে 'রনবী' নামে খ্যাত চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী বলেন, 'আর্টিস্টদের কাজ বাইরে প্রদর্শিত হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই ভালো একটি দিক। প্রবাসীরা হয়তো জানেন না আমরা এখানে কী কাজ করছি। তারা কী করছেন সেটাও আমরা জানি না। এক্ষেত্রে এমন উদ্যোগ বিনিময়ের পথ খুলে দেয়।'
চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলামের ভাষ্য, 'বরাবর আর্ট-কালচারের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন সমাজের ধনী ব্যক্তিরা। এখন হয়তো এই জায়গা নিয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। শিল্পের বিকাশের জন্য এই পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি জরুরি। নিউইয়র্কের একটি প্রফেশনাল গ্যালারিতে হবে এই প্রদর্শনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ তা দেখবেন। ছবি বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। এটা অবশ্যই পজিটিভ একটা দিক।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন মনে করেন, 'আমাদের শিল্পীদের কাজ দেশের বাইরে তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। এসব কাজে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে তা যথেষ্ট না হলেও অপ্রতুল নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্ত অযোগ্য মানুষগুলোর কারণে সেটা হয়নি। তাই বেসরকারি উদ্যোগে এমন একটি প্রদর্শনীর আয়োজন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।'
এমন একটি উদ্যোগ নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্যও অনুপ্রেরণার হবে মন্তব্য করে শিল্পী আবুল বারক আলভী বলেন, 'এমন কোনো আয়োজন মানেই নতুন যোগাযোগ। বিনিময়ের সুযোগ তৈরি। এতে ইয়াংরাও উপকৃত হবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে বেসরকারি উদ্যোগেই শিল্পীদের মধ্যে এমন প্রচুর যোগাযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশে এই ধারাটি সেই অর্থে নেই। তাই অবশ্যই এটি একটি উৎসাহজনক ব্যাপার।'
এখান থেকে ১০ বছর আগে নিউইয়র্কেই অভিনেতা-চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেনের চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল একই আয়োজক প্রতিষ্ঠান। গতকালের নৈশভোজেও উপস্থিত ছিলেন আফজাল। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের আয়তন ছোট হতে পারে। কিন্তু আমাদের শিল্পীদের মেধার আয়তন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের শিল্পীদের তুলনায় কম নয়। এই প্রদর্শনী বহির্বিশ্বের কাছে দেশের শিল্পীদের সেই পরিচয়কে তুলে ধরবে।'
নৈশভোজে উপস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম শিল্পীদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন স্বাধীনতার সময়, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। একই পরিক্রমায় নিউইয়র্কে আপনাদের কাজের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরবেন। এটা আমাদের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও।'
Comments