সময় রাঙানোর ব্রত

আমার রঙ-যাত্রা শুরু হয়েছিল চারুকলার ছাত্রাবস্থায়। বিপ্লব, আমি, মামুন আর বাবু। ওই সময়ে নারায়ণগঞ্জে চারজন মিলে নানা অনুষ্ঠানের কাজ করে দিতাম। বিয়ে, গায়ে হলুদের স্টেজ তৈরি, জন্মদিন ইত্যাদি। ছাত্রদের ভাষায় সোজা বাংলায় যাকে বলে ক্ষ্যাপ। পড়াশোনার সহায়ক হয়, হাতখরচও উঠিয়ে নেয়া যায়। তখনো রঙ-এর চিন্তা মাথায় আসেনি।


এভাবে কাজ করতে করতেই দেখা গেল, লোকজন কাজের সময় আমাদের খোঁজ করে পাচ্ছে না। স্বাভাবিক, মোবাইল ছিল না, চারজন চার জায়গায় থাকি। মনে হলো, আমাদের একটা ঠিকানা দরকার। এই ঠিকানা খুঁজতে গিয়েই রঙ-এর সৃষ্টি। তখন নারায়ণগঞ্জের সান্ত¦না মার্কেট খালিই পড়ে ছিল। সেখানে চার বন্ধু ভেতরের দিকে কম পয়সার ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া করলাম।


এবার পুঁজির সংস্থান করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। সবাই ছাত্র। কিছুটা ক্ষ্যাপের কাজ করে করে জমা ছিল, কেউ বাড়ি থেকে বা লোন করে আনল। এভাবে চারজনের মূলধন উঠল হাজার চল্লিশেক টাকা। তার অর্ধেকই খরচ হয়ে গেল দোকান সাজাতে, বাকিটা কাজের অনুষঙ্গ কিনতে। সমস্যা হলো তারপরে। এই আয়োজন ছিল মওসুমি, কিন্তু খরচ দিতে হতো নিয়মিত। ভাবলাম দোকানে কিছু তো রাখা দরকার। আরকি, বন্ধুর বোন শাড়ি বানাবে বা আত্মীয়-স¦জনদের মাঝে কেউ কোনো বিশেষ ডিজাইন, আমরা নিজেরাই কাজটা চেয়ে নিয়ে করে দিতাম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কাজ, নিজেরাই আবার দোকানে বসি। রোজা উপলক্ষে বেশকিছু কাজ নিজেরাই করলাম যেটায় আমাদের বেশ নাম ছড়িয়ে গেল। এভাবে দোকানের পরিসরও বেড়ে গেল। একশ’ থেকে দুইশ’ স্কয়ারফিট, সেখান থেকে দোতলাতেও একটা দোকান। এভাবেই রঙের সম্প্রসারণ আর একটি ব্র্যান্ডের জন্ম। ছড়িয়ে যাওয়া মানুষের মাঝে। তবে এগিয়ে চলার মাঝে তো বাধা আসে। নানা ঘটনা বিমর্ষ করে, তবু এগিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে চলে যায় বাবু ও মামুন।  আমরা দুজনে মিলে রঙকে এগিয়ে নিতে থাকি। কিন্তু ২০১৫ সালে, মানে সৃষ্টির প্রায় ২১ বছর পরে সময়ের প্রয়োজনেই বাঁধন আলগা হয়। জন্ম হয় রঙ বাংলাদেশ-এর। যেটা এখন দেশি দশের অন্যতম সদস্য। পুরোপুরি নিজে তত্ত্বাবধানে, আমার সহকর্মীদের সহায়তায় রঙ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।


শুরুতে কোনোদিনই ভাবি নাই এভাবে একজন ডিজাইনার হব, কোনোদিন এমন একটা অবস্থানে আসব।  ছোটবেলায় আমার পুরোটা জীবন ছিল বাবাকে ঘিরে। অসম্ভব খেয়ালি একজন মানুষ ছিলেন আমার বাবা। কলেজে শিক্ষকতা করতেন। সেখান থেকে তাকে পুঁথিঘর নামের একটি গ্রন্থাগারে নির্বাহী করে নিয়ে আসেন চিত্তরঞ্জন সাহা। বেশ কিছুদিন কাজ করলেন, ভালো লাগছিল না এক পর্যায়ে আর সেই কাজ। একদিন বেড়াতে গেছেন বিক্রমপুরের ইছাপুরা গ্রামে। সেখানেই দেখলেন নতুন একটা স্কুল হচ্ছে, ১০০ বছরের পুরনো স্কুল, বাজার সব মিলিয়ে বেশ সমৃদ্ধ একটি জনপদ। যদিও তখন সেখানে বিদ্যুৎ যায়নি। কিন্তু বাবার ভালো লেগে গেল। সেখান থেকেই অব্যাহতিপত্র পাঠিয়ে দিলেন পুঁথিঘরে। আবার শুরু করলেন শিক্ষকতা।


অসম্ভব উদার মনের মানুষ ছিলেন আমার বাবা। কখনো জোর করতেন না, আবার তিনি ছোট হয়ে যান, এমন কিছুও হতে দিতেন না। ছোটবেলায় অসম্ভব স্কুলভীতি ছিল আমার। প্রথম স্কুলে যাই ছয় বছর বয়সে। প্রথমদিন স্কুলে গিয়েই পালিয়ে এসেছিলাম। স্কুল থেকে রিপোর্ট এলো, মা জোর করে স্কুলে পাঠাতে লাগলেন, আমি বারান্দার খুঁটি ধরে চোখের জল ফেলতে লাগলাম। বাবা এলেন, বুঝলেন, বলে দিলেন ওকে আর জোর করে পাঠানোর দরকার নেই। ইচ্ছে হলে নিজেই যাবে। সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি আমরা বছর তিনেক পরে। নতুন জায়গার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে আবার আমার স্কুল যাওয়া শুরু।
খুব ইচ্ছে ছিল প্রকৌশলী হব। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিংয়ে ছিলাম। জাহাঙ্গীরনগরের বিবিএ, অর্থনীতি দুটোতেই সুযোগ পেলাম। ভাবছিলাম কোনটায় ভর্তি হব। এরই মাঝে একদিন মামুন আর আরেক বন্ধু অনুরোধ করল চারুকলায় পরীক্ষা দিতে। ওদের সুবিধা হবে, ভেবে দিলাম। ওদের কারোরই হলো না, আমি দ্বিতীয় স্থানে টিকে গেলাম।


সেই থেকে চারুকলায় শুরু। গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের ছাত্র, একসময় ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে গেল। তবে এই কাজ আমায় আনন্দিত করে। এখানে আমি চন্দ্র শেখর সাহার মতো পথপ্রদর্শকের আশীর্বাদ পেয়েছি। তার কাজ আমাকে সবসময়ই অনুপ্রাণিত করে। রঙ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার স্মৃতি। নারায়ণগঞ্জের সেই ছোট্ট দোকানটির ফিতা কেটেছিলেন আমার বাবা। তার কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তার স্মৃতির পাশাপাশি আমার সহযোগীদের প্রতি দায়িত্ববোধ আমায় তাড়িত করে। অনেক মানুষের অন্ন সংস্থানের সঙ্গে এখন রঙ বাংলাদেশ জড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দেশে এবং দেশের বাইরে একে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করাটাই এখন আমার লক্ষ্য। রঙ বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে তিনটি সাবব্র্যান্ড। তারুণ্যের ভুবন ওয়েস্ট রঙ, বরিষ্ঠদের জগৎ শ্রদ্ধাঞ্জলি আর বাংলাদেশকে স্মৃতি উপহারের মধ্য দিয়ে ব্র্যান্ডিং করার জন্য আমার বাংলাদেশ। সব বয়সের সবসময়ের উপযোগী পোশাক আর উপহারে ভোক্তাদের পছন্দ ছুঁতে নিরন্তর প্রয়াসী রঙ বাংলাদেশ।
রঙ থেকেই রঙ বাংলাদেশ। সময়কে রাঙিয়ে তোলার যে ব্রতে নিরন্তর সৃষ্টির নেশায় শুরু হয়েছিল একদিন নতুন চলায় সেই লক্ষ্যে অবিচল আমরা। এরপর দীর্ঘ চলার পথে অর্জিত নানা অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করেই নতুন অভিযান। আত্মপ্রকাশ রঙ বাংলাদেশ-এর। অতীত আমাদের প্রেরণা। বর্তমান আমাদের প্রণোদনা। অর্জিত সাফল্যকে সঙ্গী করে বাংলাদেশের যথার্থ ব্র্যান্ড হিসেবে দেশের পতাকা বহনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভবিষ্যতে পা রাখতে চাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সময়ের সঙ্গে থেকে ফ্যাশনের ট্রেন্ডকে অনুসরণ করে বাংলাদেশকে পোশাকের ক্যানভাসে প্রতীয়মান করতে বদ্ধপরিকর রঙ বাংলাদেশ। শুরু থেকেই থিমভিত্তিক কালেকশন তৈরির মাধ্যমে সৃজনের স্বকীয় উপস্থাপনের প্রয়াসী আমরা। তাই যেখানেই যাই না কেন, রঙ বাংলাদেশ মিশে থাকে আমার সত্তায়।

 

Comments

The Daily Star  | English
caretaker government proposal Bangladesh

Restoration of caretaker system to be proposed

The restoration of the caretaker government and the introduction of a bicameral system in parliament will be among the recommendations to be proposed by the Constitution Reform Commission.

5h ago