মায়াবী শহর থেকে বিস্ময়কর ব্রিজ

ড্রেসডেন থেকে বাস্তেই ব্রিজ
রাতের ঝলমলে ড্রেসডেন-এ লেখক ও শাহরিয়ার লেনিন

ভ্রমণ কখনো শখ, কখনো নেশা, কখনো জীবন। আমরা দু’জন- ‘প্রায় যাযাবর’ এক দম্পতি; ইউরোপের দুটি শহরে পড়াশোনা করতে আসার সুবাদে বেশ ঘুরছি এ-দেশ, ও-দেশ। সুযোগ পেলেই আমি আমস্টারডাম, আর আমার সঙ্গী শাহরিয়ার লেনিন হেলসিংকি বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে মিলিত হই নতুন কোনো গন্তব্যে। তারপর ক’টা দিন দারুণ কেটে যায় ব্যাকপ্যাক ট্র্যাভেলিং আর উপভোগ্য সব অ্যাডভেঞ্চারে। নতুন শহরে বেড়াতে গেলে আমাদের উদ্দেশ্য থাকে অন্তত একটা দিন শহরের বাইরে গিয়ে প্রকৃতির খনি আবিষ্কার করা। জার্মানির শহর ড্রেসডেনের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বার্লিন থেকে মাত্র ১৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ড্রেসডেন শহরে খুব সহজে বাসে বা ট্রেনে করে চলে আসা যায়। টিকিটও ভীষণ সস্তা। আগে থেকে অনলাইনে কেটে রাখলে মাত্র ৫-১০ ইউরোতেও টিকিট মেলে! আর বাসে বা গাড়িতে সময় লাগে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক। তো, রাজধানী বার্লিনে কিছুদিন কাটিয়ে একদিন শেষ বাসে করে গভীর রাতে আমরা এসে পৌঁছলাম মায়াবী শহর ড্রেসডেনে। ড্রেসডেন ট্রিপের প্রথম দিনটা কাটল শহর দেখে। বার্লিনের মতো আধুনিক শহর থেকে আসার ফলে মধ্যযুগে গড়ে ওঠা এ শহরের পুরনো নিদর্শনগুলো আমাদের মুগ্ধ করল। ইতিহাস ও স্থাপত্যের অসাধারণ সংমিশ্রণ ঘটেছে ড্রেসডেনের ওল্ড টাউনে। ড্রেসডেন প্রাসাদ, জিউঙ্গার, ব্রুল’স টেরাস, শোলস আলব্রেখসবার্গ ইত্যাদি সব প্রাসাদ ও বাগান ছাড়াও কয়েকটি জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি যেমন আলবার্টিয়াম, ড্রেসডেন সিটি মিউজিয়াম, সিটি আর্ট গ্যালারি ঘুরে ঘুরে দেখলাম যতটা সম্ভব। সন্ধ্যার পর এলবে নদীতে ঝলমলে আলোকিত শহরের প্রতিবিম্ব দেখে নীরব বিস্ময়ে বুঁদ হয়েই ছিলাম দু’জনে।

পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা রাথেন গ্রাম। ছবি: শাহরিয়ার লেনিন

ড্রেসডেনের দ্বিতীয় দিন আমরা যাব একটু দূরে সেটা আগেই ঠিক করা ছিল। যেহেতু খুব সকালে রওনা দেব, তাই ট্রেনের সময়সূচি আর দাম সম্পর্কে আগেই জেনে নিলাম। খরচ নাগালের মধ্যেই। ড্রেসডেন হফবানহফ হলো শহরের প্রধান স্টেশন। সেখান থেকে বাড শান্ডাউ পর্যন্ত ডে টিকিট মাথা পিছু ১২ ইউরো বা কিছু বেশি। আর দু’জন থাকলে ফ্যামিলি টিকিট কাটা যায় একসঙ্গে ১৯ ইউরোতে। এই টিকিটের সুবিধা হলো, আপনি ট্রেন, ট্রাম, বাস সবকিছুতেই সারাদিন যতবার খুশি ব্যবহার করতে পারবেন। এস-ওয়ান ট্রেন শোনায়েভ বাড শান্ডাউ-এর দিকে যায়। এটাতেই চড়ে বসুন। বাস্তেই পড়বে বাড শান্ডাউ-এর দু’স্টপ আগে। শহর থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের যাত্রা। খুব বেশি প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। কেবল কিছু খাবার, পানি ব্যাকপ্যাকে আর পরে নিন পাহাড়ে চড়ার উপযোগী জুতা (জুতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। শীতকাল হলে অবশ্যই পানিনিরোধক, চামড়ার জুতা হলে ভালো হয়। তবে সেটা যেন খুব ভারী না হয়। আর অন্য সময় হালকা রানিং শু-ই যথেষ্ট)। আমরা কিছু স্ন্যাকস নিয়েছিলাম, যা পরে খুব কাজে দিয়েছিল। কারণ পাহাড়ে ওঠার পর খাবারের কোনো দোকান নেই। ট্রেনে ভিড় একেবারেই ছিল না। দোতলায় উঠে জানালার পাশে একটা সিটে বসে চারপাশে তাকালাম। যে ক’জন যাত্রী ছিলেন তারা সবাই বোধহয় ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছিলেন। কারণ সে সময়টায় ইস্টারের বন্ধ চলছিল। বেশ খুশি খুশি ভাব ছিল সবার মধ্যে। ট্যুরিস্ট খুব কম দেখা গেল। শহর ছাড়িয়ে ট্রেন যখন এলবে নদীর তীর ধরে চলতে শুরু করল তখন আমাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। নদীর তীর ঘেঁষে পাহাড়ি শহর। একেবারে ছবির মতো সুন্দর বাড়িঘর। যেমন অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি, তেমনি সুদৃশ্য নকশাদার বাড়িঘর। আমরা উতলা হয়ে উঠছিলাম এ রকম কোনো একটা শহরে নেমে খানিক হাঁটাহাঁটি করার জন্য। পিরনা তো পুরোপুরি মন কেড়ে নিল। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা চমৎকার বাড়িগুলো সত্যি হিংসা জাগায় এখানকার বাসিন্দাদের ওপর। মনস্থির করি, পরেরবার এসে এখানে অন্তত এক রাত কাটিয়ে যাব। আবার মনে হচ্ছিল, শুধু এক রাত-বা কেন? থেকেই যাই না এই পাহাড়ি শহরে কোথাও অজ্ঞাতনিবাসে!

কুরর্ট রাথেন ট্রেন স্টেশন। ছবি: শাহরিয়ার লেনিন

যাহোক, এসব দেখতে দেখতেই আমাদের গন্তব্য চলে এলো। নামলাম কুরর্ট রাথেনে। এলাকাটা স্যাক্সনি সুইজারল্যান্ডের মধ্যে। ছোট্ট এই স্টেশন থেকে কিছুটা হেঁটে নদীর পাড়ে ফেরির জন্য অপেক্ষা। ফেরির টিকিট (মাথাপিছু ১.৫০ ইউরো) কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। নদী বেশ খরস্রোতা, যদিও গভীরতা তেমন নয়। বুঝলাম কাছাকাছিই এর উৎস আছে। নদী পেরিয়ে এ পাড়ে পৌঁছে গেলাম মাত্র দশ মিনিটেই। এরপর একটু চারপাশে হেঁটে বেড়ালাম। আর সেই সঙ্গে চলছিল চারপাশের মোহনীয় সৌন্দর্য ক্যামেরায় বন্দি করা।

এবার বাস্তেই-এর উদ্দেশে যাত্রা শুরু, মানে এলবে স্যান্ডস্টোন মাউন্টেইনে চড়া শুরু। পাহাড় বেয়ে খানিকটা ওঠার পরই শুরু হলো জঙ্গল। প্রকৃতি অপরূপ থেকে অপরূপতর হতে লাগল। বসন্তকাল চলছিল তখন। নানা রঙে রঙিন চারপাশ। ঝরাপাতার অরণ্য আর ধাপে ধাপে ওপরে ওঠার পাহাড়ি সিঁড়ি। কিছু জায়গায় কাঠের রেলিং আছে। তবু সাবধানে উঠতে হয়। আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় বেশ পিচ্ছিল ছিল পথ। দু’পাশে পাথরের গায়ে বহু যুগ আগে জন্মানো শৈবালের আস্তরণ। অচেনা সব পাখির ডাক আর অন্যান্য অভিযাত্রীর পোষা কুকুরের অল্পবিস্তর ঘেউ ঘেউ- এই ছিল বলতে গেলে পশুপাখির হাঁকডাক। পথে একটু পরপরই নির্দেশক চিহ্ন দেয়া ছিল; তাই ছিল না পথ হারানোর ভয়। তাছাড়া পাহাড়ে ওঠা বা নামার সময় যাদের সঙ্গে দেখা হয় সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় একটা প্রচলিত প্রথা। অনেকেই জিজ্ঞেস করে আর কত দূর বা বাস্তেই কি এই পথে- এমন টুকটাক প্রশ্ন। হাসিমুখে একে অপরকে উৎসাহ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি।

প্রায় মাঝপথে পাহাড়ের কিনারে একটা ওয়াচ টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে পেলাম সুদূরবিস্তারী এক দৃশ্য। ক্যানভাসে আঁকা এক ছবি যেন! নদীর দু’পাশে ছোট গ্রামগুলো পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সবুজ শান্ত তটরেখা ভীষণ নরম এক চাদর বিছিয়ে দিয়েছে তার ওপর। অথচ পাশেই প্রচ- শক্তিমান পর্বতমালা। কঠিন ও পাথুরে। কী অদ্ভুত, বৈচিত্র্যময় সমন্বয়! সবাই এখানে এসে প্রিয়জনের হাত ধরে দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছিল নৈসর্গিক প্রকৃতি। পাহাড় পাড়ি দিয়ে এত ওপরে ওঠা তাহলে সার্থক হলো। তখনো আমরা জানি না আমাদের জন্য সামনে কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে!

 আরো মিনিট ত্রিশ হাইকিংয়ের পরে কাক্সিক্ষত বাস্তেই ব্রিজের মুখোমুখি হলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই ব্রিজ। প্রায় দুশ’ বছর ধরে অসংখ্য পর্যটক এখানে বেড়াতে আসছেন। প্রথমে এখানে একটি কাঠের সেতু বানানো হয়েছিল পর্বতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির জন্য। সেটা ১৮২৪ সাল। পরবর্তীতে, ১৮৫১ সালে নির্মিত হয় এই ভিক্টোরিয়ান পাথুরে ব্রিজ। ভাবতে অবাক লাগে, একদিকে প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রকৃতির এই রহস্যময় পর্বতমালা, অন্যদিকে মানুষের নির্মিত অনন্য এই সেতু। কোনোটাই যেন কারো চেয়ে কম নয়। বলা হয়, এক সময় বিভিন্ন চিত্রশিল্পীরা ‘পেইন্টারস পাথ’ পেরিয়ে এখানে আসতেন। অনেকেই এর অনেক ছবিও এঁকেছেন। বিখ্যাত জার্মান চিত্রকর ক্যাসপার ডেবিড ফ্রিয়েডরিখের আঁকা ছবিতে দেখা যায় কাঠ দিয়ে তৈরি বাস্তেই ব্রিজ। এসব পরিব্রাজকদের অস্থায়ী রাত্রিযাপনের জন্য সেসময় এখানে নির্মিত হয়েছিল সরাইখানাও। টাটকা রুটি, মাখন, কফি আর বিয়ার দিয়ে চাঙ্গা করে তোলা হতো বহুদূর থেকে আসা শ্রান্ত অভিযাত্রীদের। ভাবা যায় সেই সময়টা কেমন ছিল? কিছুক্ষণের জন্য আমরাও হারিয়ে গিয়েছিলাম ইতিহাসের পাতায়।

বাস্তেই ব্রিজের অপর পাশের অসাধারণ রক ফরমেশন। ছবি: শাহরিয়ার লেনিন

যাহোক, বাস্তেই-এর আসল রূপ দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে পাহাড়ের অন্য শাখায়। নইলে ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝবেন কী করে যে তা দেখতে কতটা সুন্দর! এজন্য আবারো ২ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে প্রবেশ। তাতে করে আপনি ঘুরে দেখতে পারবেন বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা, যেমন- নুরাথেন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা প্রাচীন চিত্র, একটা কামান, পানি ধরে রাখার চৌবাচ্চা ইত্যাদি। বাস্তেই থেকে আরো ওপরে উঠলে পাওয়া যাবে এক অত্যাধুনিক হোটেল। সময় ও সামর্থ্য থাকলে এখানে রাত্রিযাপন করা চমৎকার আইডিয়া। পাথুরে পাহাড়ের ওপরে ভোরের কোমল সূর্য ওঠার দৃশ্যটা নিশ্চয়ই শ্বাসরুদ্ধকর হবে।

এখানকার আরেকটি প্রধান আকর্ষণ হলো ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত বোহেমিয়ানদের দুর্গ কনিগস্টিন। ইতিহাসের পালাবদলে এই দুর্গ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে এখানে সংরক্ষিত হয়েছে ঐতিহাসিক দলিল ও চিত্রকর্ম, আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে যুদ্ধবন্দিদের শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরো জানতে পারলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড আর্মি একে সামরিক হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে (১৯৪৯-১৯৫৫), সোভিয়েত সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য কারাগার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বন্দিদের তালিকায় মিখাইল বাকুনিন, অসাস্ট বেলের মতো ব্যক্তিরাও ছিলেন।

এরপর নেমে আসা। নামার পথে মাঝামাঝি আরেকটা দর্শনীয় স্থান হলো আর্মসেল জলপ্রপাত। ট্রেকিং শুরুর পয়েন্ট থেকে বাস্তেই-এর মতোই দূরত্ব। চমৎকার এক ঝরনা। এর পানিরই প্রবাহ গিয়ে মিশেছে এলবে নদীতে। হাতে সময় এবং শরীরের শক্তি থাকলে অবশ্যই দেখা যেতে পারে। ঝরনার কুলকুল ধ্বনি বহুদূর থেকেই আপনাকে মোহিত করে ডেকে নিয়ে যাবে তার কাছে।

সব শেষে বাস্তেই থেকে ফেরার পালা। একইভাবে ফেরি পেরিয়ে অন্য পারে গিয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন ধরা। পাহাড় চড়ায় দক্ষ হলে পুরো পথ হাইকিং করে ফিরে আসতে ঘণ্টা চারেক লাগতে পারে। এসব পাথুরে সিঁড়ির প্রায় ৫০০ ধাপ ওঠা ও নামার ক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা ও সতর্কতাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো, অন্তত আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। অবশ্য বিভিন্ন মিডিয়ার সূত্রমতে, ড্রেসডেন শহরটি বর্তমানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য তেমন অনুকূল নয়। সম্প্রতি সেখানকার স্থানীয় নব্য-নাৎসিরা বর্ণবাদী কিছু কার্যক্রম চালিয়েছে। তাই একটু সাবধান থাকতে দোষ নেই। তবে আমাদের যাত্রায় (২০১৬ সালের মার্চে) আমরা সেখানকার মানুষের হাসিমাখা মুখের স্মৃতি নিয়েই ঘরে ফিরেছি। মনের মাঝে রয়ে গেছে আবারো ফিরে আসার আকাক্সক্ষা। আর নানা রকম বাধা-বিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে এগিয়ে যাওয়াতেই তো একজন অভিযাত্রীর আনন্দ!

Comments

The Daily Star  | English

Yunus urges Pakistan PM to settle issues of 1971

he two leaders also expressed their desire to extend cooperation in new areas

10m ago