বয়ঃসন্ধির ভ্রমণ
বারো থেকে উনিশ; বয়ঃসন্ধি। একদিকে শৈশব ফেলে এসে বড় হয়ে ওঠা, অন্যদিকে যৌবনের অধরা আনন্দের হাতছানি। দোটানায় পড়ে এ বয়সে কিশোর-কিশোরীরা না পারে নিজেকে শিশুদের শ্রেণিতে নামিয়ে নিতে, না পায় বড়দের শ্রেণিতে ঠাঁই।
একদিকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ুউড়ু ভাব, অন্যদিকে পরিবার কিংবা সমাজের সদস্যদের ডানা ছেঁটে দেয়ার অভিমান। সব মিলিয়ে কিশোর-কিশোরীদের মন পড়ে বিপাকে। পাশাপাশি শারীরিক পরিবর্তন তো রয়েছেই। বেখাপ্পা এ বয়সে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীই ব্যক্তিজীবন পরিচালনায় খেই হারিয়ে ফেলে।
শৈশবে যে দৃষ্টি বাড়ির উঠান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, কৈশোরে তার পরিধি বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক শাসনের বলয় ভেদ করে ওরা পা রাখতে চায় বাইরের জগতে, নিজেকে মেলে ধরতে চায় নিত্যনতুন দৃশ্যপটে। বইয়ের পাতা কিংবা টিভি পর্দায় ওরা পরিচিত হতে থাকে নতুন নতুন স্থানের সঙ্গে। একসময় সেসব জায়গা সশরীরে পরিদর্শনে মরিয়া হয়ে ওঠে ওদের কৌতূহলী মন।
পরিবারের বলয় ছাড়িয়ে জগৎটিকে উপভোগ করতে চায় একা কিংবা সবান্ধব। গন্ডগোল বাধে তখনই। কেননা, কিশোর বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ের মনে এমন যুক্তির উদ্ভব হয়ে যে, ওরা এখন পরিণত, একা একা বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু পরিবার ও সমাজের খাতায় ওদের নাম তখনো ছোটদের তালিকায়ই লিপিবদ্ধ থাকে। এ টানাপড়েন সহ্য না করতে পেরে অনেক কিশোর-কিশোরীই কখনো একা আবার কখনো সবান্ধব ঘরছাড়া হয়।
কিছুদিন নিরুদ্দেশ থেকে পুনরায় ঘরে ফেরে। কৈশোরে এ ধরনের ভ্রমণ একদিকে যেমন বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ায়, তেমনি ক্ষতি হয় ওদের পড়াশোনারও। তা ছাড়াও মন্দ লোকের খপ্পরে পড়ে বরবাদ হয়ে যেতে পারে ওদের জীবন।
তাই বলে কিশোর-কিশোরীদের পায়ে শিকল পরিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখা উচিত হবে না। ওদের বোঝাতে হবে যে ওরা বড় হয়েছে বটে, কিন্তু ঠিক কতটা বড় হয়েছে। ওদের সীমা বুঝিয়ে দিতে হবে আদর ও যত্নের মাধ্যমে। এ বয়সে নিষিদ্ধ বস্তুর ওপর ছেলে-মেয়েদের প্রবল আগ্রহ জন্মায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- যে বিষয়ে ওদের নিষেধ করা হয়েছে, সে বিষয়ে কেন নিষেধ করা হলো বা ওসবের ক্ষতিকারক দিক কী কী- এ সম্পর্কে ওদের স্পষ্ট ধারণা থাকে না।
তাই কোনো কাজ করতে নিষেধ করা হলে, কেন সেই কাজে নিষেধ করা হলো এবং তার ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে ওদের যথোপযুক্ত ধারণা দিতে হবে। ভ্রমণ করা খারাপ কিছু নয়, কিন্তু সেই ভ্রমণ হতে হবে যথাসময়ে। যে ভ্রমণ পড়াশোনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কিংবা বাবা-মায়ের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সে ভ্রমণ না করাই ভালো।
কৈশোরে ঘরছাড়া হওয়া এবং কাউকে কিছু না বলে ভ্রমণে বেরিয়ে যাওয়া রোধ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে পিতা-মাতাকেই। অবসর পেলে, বছরান্তে কিংবা ছুটিতে সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে ভ্রমণে। নিত্যনতুন জায়গায় ওদের নিয়ে গিয়ে নতুন আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের কৌতূহল মিটিয়ে দিতে হবে পিতা-মাতাকেই।
তবে সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার পর এমন কোনো শাসন করা যাবে না যাতে ও নিজেকে পরাধীন মনে করে। ওকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দিতে হবে। তবে পেছন থেকে গোপন চোখে ওকে অনুসরণ করে যেতে হবে পিতা-মাতাকে। অর্থাৎ, সন্তানকে স্বাধীনতা দিতে হবে গোপন নজরদারির মধ্যে রেখেই। আর পারিবারিক ভ্রমণে অবশ্যই ওদের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়েই গন্তব্য বাছতে হবে। এমনকি ওরা যেহেতু এ যুগের, টেকনোলজি সম্পর্কে জ্ঞান সম্যক।
তাই ওদের তালুবন্দি বিশ্বের হদিস। ফলে ওদের চিন্তাভাবনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা উচিত হবে না। বরং কাজেই লাগবে। তাই কোনো শহরে বা কোথাও যেতে হলে তাদের পরামর্শ নিতে হবে। তাতে ডাবল লাভ। প্রথমত ওদের সম্পৃক্ত করা আর দ্বিতীয়ত তাতে ওরাও নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারবে।
এছাড়া খোঁজখরর যেহেতু ওরা বেশিই রাখে তাই, কোন শহরে গিয়ে কোথায় বেড়ানো হবে, শপিংইবা কোথায় করা হবে কিংবা সেই শহরের সেরা রেস্তোরাঁ কোনটা তা ওরাই জানাতে পারবে। এতে করে ওরা খুশি হবে। পারিবারিক ভ্রমণ হবে দারুণ উপভোগ্য। এর মধ্য দিয়ে বয়ঃসন্ধির সন্তানের পলায়নপরতা কিংবা অসময়ে ভ্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে।
Comments