‘ভাঙচুর না হলে হবে না’

পরিচালক শামীম আখতারের নতুন সিনেমা ‘রিনা ব্রাউন’, সিনেমা নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা। রিনা ব্রাউনের নির্মাণের নেপথ্য কথা নিয়ে আড্ডায় হাজির হয়েছিলেন। সঙ্গে আরো ছিলেন এই সিনেমার অন্যতম দুটি চরিত্রের অভিনয় শিল্পী প্রমা পার্বণী ও মাহফুজ রিজভী। আড্ডার সঞ্চালক আনন্দধারা সম্পাদক রাফি হোসেন

শামীম আখতার; ছবি : শাহরিয়ার কবির হিমেল

রাফি হোসেন : আপনার সিনেমা ভাবনা ও নতুন সিনেমা রিনা ব্রাউন সম্পর্কে জানতে চাই?

শামীম আখতার : আমরা যারা ছবি বানাই তাদের বিরাট বড় একটা স্বপ্ন থাকে। নানা ধরনের ছবি করতে চাই। চলচ্চিত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা বিনোদনের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমন সবকিছুর জন্য। আমাদের একটা আন্দোলন ছিল বরাবরই ভালো ছবি করব, ভালো ছবি দেখব। একটা সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হবো। সেই কারণে চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। কিন্তু যেটা হয় আমরা যে স্বপ্নটা দেখি সেটা এটা দ্রুত করতে হয়। অনেক কিছু ঝেড়ে ফেলতে হয়। যেভাবে ভাবি সেভাবে করা হয় না। হয়তো আমরা স্ক্রিপ্ট ভালো করছি কিন্তু শ্যুটে যাওয়ার পর একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তার মানে কি আমরা ভুল শিখেছিলাম? এর আগে বক্তব্যধর্মী লম্বা সিনেমা করেছিলাম। তবুও এই সিনেমা একটা অ্যাপিল তৈরি করেছিল। একটা ধারা এনেছিল। বাংলাদেশে ফিল্মের কারিকুলামে আমার ছবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘ইতিহাস কন্যা’। আমি নিজেই এর মর্ম বুঝিনি। যখন বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা আমাকে বলছে ‘ইতিহাস কন্যা’ তাদের ভালো লেগেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম।

রাফি হোসেন : তাহলে মনে করছেন সব ধরনের ছবি এখন দেখছে। কমিউনিকেশনটা গড়ে উঠছে।

শামীম আখতার : অবশ্যই গড়ে উঠছে। আমরা যারা ছবি করতে যাই তারা কারো না কারো ভাবধারা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবি করতে যাই, যারা সিনেমায় বিখ্যাত হয়েছেন এমন করে। অনুকরণ করতে যাই। দেখন পুরো বিষয়টা ভেঙে যায়, খেলো হয়ে যায়।

রাফি হোসেন : তাহলে কি বলতে চাইছেন আপনার রিনা ব্রাউন নিজের ধারা থেকে বের হয়ে বানিয়েছেন?

শামীম আখতার : আমি যেটা ফোকাস করতে চাইছি। সেটা হলো মৌলিক ধারা বলে একটা ধারা আছে। যেমন সূর্য দীঘল বাড়ি নামে একটা বিখ্যাত সিনেমা আছে। এটা ছাড়া তেমন মৌলিক ছবি দেখি না বেশি। একেবারে নিটোল নিখাদ ছবি। ঘুড্ডি ভালো লেগেছিল। ফর্ম ভাঙার একটা ব্যাপার ছিল। এছাড়া আলমগীর কবিরের কিছু ছবি। এখন যারা এসেছে তাদের মধ্যে অনেকেই জোরেশোরে ভাঙার একটা চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে আমি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কথা বলব, অমিতাভ রেজার কথা বলব। আয়নাবাজি, টেলিভিশন। এই ভাঙচুরটা না হলে হবে না। সেটাই আমি বলতে চাচ্ছি। আমাদের সময়ে খুব সংযত ছিল। এই ভাঙচুর ছাড়া হবে না। গ্র্যামার ফলো করার একটা বিষয় ছিল। এই বিষয়টা বলতে চাচ্ছি। আমার ছবিটা একটু অন্যরকম বলব তার কারণ আমার বেশি কথা বলার অভ্যাস রয়েছে। ডায়ালগ গল্পে আমার মনোযোগ । মুচমুচে একটা বিষয় যে থাকতে পারে সেই বিষয়টা রয়েছে। মধ্যবিত্তরা সিনেমায় আসুক সেটা আমি চাই। নতুন দর্শকদের জন্যও।

মাহফুজ রিজভী; ছবি : শাহরিয়ার কবির হিমেল

মাহফুজ রিজভী : আমার প্রথম সিনেমা এটা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি। সিনেমার সঙ্গে জড়িত ছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ হয়নি। আফসানা মিমির রান সিনেমার সঙ্গেও ছিলাম। যেহেতু টিভি নাটকের সঙ্গে আছি। থিয়েটারের সঙ্গেও জড়িত, তাই কিছু জায়গায় নতুন লেগেছে। রিনা ব্রাউন সিনেমায় অভিনয় করেছি একেবারে পরিচালকের সঙ্গে স্যারেন্ডার করে। যেটা বলেছেন সেটাও করেছি। যেটা করতে না করেছেন সেটা করিনি। এক বছর এটার মধ্যে ছিলাম, গল্প নিয়ে কথা বলা, রিহার্সেল করা। অনেক আলোচনা হয়েছে।

রাফি হোসেন : কাজ করতে গিয়ে কী মনে হয়েছে নতুন জেনারেশন কীভাবে এটা গ্রহণ করছে

মাহফুজ রিজভী : এই সিনেমার মূল বিষয় হলো গল্প আর স্টোরি টেলিং। বাংলাদেশের মুভি হিসেবে অনেক এগোনো একটা ছবি। মজাটা আছে। ভাঙাগড়ার একটা বিষয় চলছে তার মধ্যে রিনা ব্রাউন দারুণ। যদি বেশিরভাগ মানুষের কমার্শিয়াল মানুষ দেখে তার মধ্যে এটা মানুষ দেখেছে। শামিম আপা একটা কথা বলে মধ্যবিত্তের সিনেমা রিনা ব্রাউন।

রাফি হোসেন : তোমার মায়ের ছবিতে তুমি অভিনয় করছ। বিষয়টা একটু জটিল, তারপরও বলো তোমার অভিজ্ঞতা?

প্রমা পার্বণী; ছবি : শাহরিয়ার কবির হিমেল

প্রমা পার্বণী : আমার আগে থেকে কোনো প্রিপারেশন ছিল না। অন্যদের সঙ্গে যেমন কাজ করি, এটাতেও তেমনভাবে কাজ করেছি। এই কারণে মায়ের কাছে অনেক বকা খেয়েছি। একটু নার্ভাসনেস ছিল। তবে চেষ্টা করেছিলাম ভালো কিছু করার।

রাফি হোসেন : তোমার বন্ধুরা কীভাবে এটা দেখছে?

প্রমা : আমার বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন একটা ভাবিত না। এটা আমাদের দোষ না। এটার দোষ আগের জেনারেশনের। তারা আমাদের সেইভাবে বোঝাতে পারেনি। আমরা সেকেন্ড ওয়ারের ওপর সিনেমাগুলো কিন্তু দেখতে আগ্রহী। তার কারণ তাদের বলার ভঙ্গি দারুণ। আমার মনে হয় এখন পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভালোভাবে প্রেজেন্ট করতে পারিনি। বরং একটু পচিয়ে দিয়েছে। দাগ কাটার মতো কোনো ছবি এখনো তৈরি হয়নি। ধারেকাছে হয়তো গেছে কিন্তু তেমনভাবে হয়নি। আমার মনে হয় সুন্দরভাবে প্রেজেন্ট করলে অবশ্যই হবে। কিন্তু আমাদের জেনারেশন এখন দেখতে চায় না। তবে অনেক কিছু শেখার আছে, জানার আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমার মনে হয় অনেকের কাছে অনেক গল্প পাওয়ার আছে। আমার মা লিখতে পারে বলে হয়তো তার আবেগ দিয়ে লিখেছেন। কিন্তু অনেকেই সেটা ব্যক্ত করতে পারেন না। গ্যাপ একটা ক্রিয়েট হয়েছে। এটা ঠিক করা উচিত। আমাদের ইতিহাসটাকে অনেক বড়ভাবে সুন্দর করে প্রেজেন্ট করতে হবে।

রাফি হোসেন : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনি তো অনেক সিরিয়াস।

শামীম আখতার : প্রমা যখন ছোট ছিল তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিষয়গুলো ওদের মাথায় দেয়ার চেষ্টা করেছি। ফিউচার থাকলে পাস্টের দিকে তাকাতে হবে এটা শেখাতে পেরেছি। কিন্তু আমরা শুধু ইভেন্টগুলো দেখাচ্ছি। কিন্তু কেন হয়েছিল এটা নিয়ে বিস্তারিত বলছি না। পাকিস্তানি কোনো জিনিস ধরে না এরা। আমিও তেমন। পতাকার বিষয়ে আমরা সচেতন। প্রতি দিবসে আমরা একসঙ্গে পতাকা তুলি। আমি ভুলে গেলে প্রমা আমাকে মনে করিয়ে দেয় মা সব ঠিকঠাক আছে তো। আমার কথাটা হলো, আমি যদি ধাপে ধাপে বিবরণটা না জানি তাহলে কী হবে? হবে না। অতীত না জানলে সে অন্ধ। আজকের জেনারেশন একটা অন্ধের মতো যাচ্ছে। চলচ্চিত্র আমাদের বড় একটা মাধ্যম, এটাকে কিন্তু আমরা কাজে লাগাতে পারতাম। কিন্তু আমরা ইমোশনটাকে বেশি কাজে লাগাই ছবি বানাতে গিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রসালোভাবে বড়ভাবে কোনোকিছু বানাতে পারিনি। একাত্তর বর্ণাঢ্য একটা সময়, বড় একটা বিষয়। তবে যুদ্ধ নিয়ে অনেক ভালো ভালো ছবি হচ্ছে দেশের বাইরে। তবে আমাদের এখানে একই চর্বিতচর্বণ বিষয়টা হলে হবে না। আমাকে যদি কেউ বলে তাহলে আমি সত্যিকারের একটা মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখতে চাই। বানাতে চাই। আমি হ্যাপি না আমার ছবি নিয়ে।

মাহফুজ রিজভী : যাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের ভেতর আসলে মুক্তিযুদ্ধ আছে কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। ১৯৭১ সালের পর সেই ইনফরমেশনগুলো দেয়া হয়েছে কিনা। ফ্যামিলি, পারিবারিক, রাজনৈতিক বিষয়গুলো। আমাদের পাঠ্যবই নিয়েও কিছু ঝামেলা হচ্ছে। আমার মনে হয় ছোটবেলা থেকে বিষয়গুলো পরিবার থেকে জানানো উচিত, বোঝানো উচিত। সিনেমা থেকে আর কতটা পারা যায়। পাঠ্যবই ভালো ভূমিকা রাখে। অনেক কিছু হয় না। যারা মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখবে তারা সেই কনসেপ্টটা ধারণ করে কিনা? তার সেই শিক্ষা আছে কিনা? এটাও ভাবতে হবে। এই জেনারেশনকে দোষ দিয়ে লাভ কী? তার পরিবার জানে কিনা সেটা আগে বুঝতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

2h ago