যুক্তি, তর্ক আর নিজের ‘বেমানান’ সিদ্ধান্ত

যুক্তি, তর্ক আর নিজের ‘বেমানান’ সিদ্ধান্ত
ছবি: স্টার

যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসবার পর সব থেকে বেশি যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয়েছে তা হলো; 'দেশে ফিরে যাব, নাকি এখানেই থেকে যাবার পরিকল্পনা করব?' আমি আদতে খুবই 'হোমসিক' একজন মানুষ। 

এর সঙ্গে আরও কয়েকটা বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যায় নিজের সম্পর্কে (নিজ সম্পর্কে বলেই আর উল্লেখ করছি না)। গত ১১ মাসে এই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছি সহস্রবার। দেশ কিংবা ভিনদেশ, আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী থেকে শুরু করে বন্ধুমহল, সহকর্মী সবারই এই একই প্রশ্ন। 

শুধু সরল বাক্যের একটি প্রশ্ন হলেও এই লেখার সূচনা হয়তো এভাবে করতাম না। যাই হোক! খুবই প্রচলিত এই প্রশ্ন এবং সঙ্গে আমার 'বেমানান' উত্তরের পেছনের কারণগুলোও খোলা চোখেই ধরা পড়ে।

গত বছরের আষাঢ় মাসের এক উষ্ণ বিকেলে বাড়ি ফিরছিলাম। অফিসের গাড়িতে ট্রাফিকে আবদ্ধ হয়ে খেয়াল করছিলাম পথের অগুণতি মানুষকে। এই সীমাহীন ট্র্যাফিকে আটকে পড়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, 'এত-শত ভিড়, দাবদাহ, যান্ত্রিকতার মাঝেও কেন এই মানুষগুলো ঢাকাকে জাদুর শহর বলে?' নিজেই পরক্ষণে উত্তর গুছিয়ে নিলাম, 'এই জাদুর শহর শব্দটা গানের লিরিক বা বিজ্ঞাপনেই হয়তো বলা হয়। বাস্তবে ঢাকা শহর বা দেশের অন্যান্য যে শহরগুলো আছে, সেখানকার রাস্তা, অলি-গলিতে নিশ্চয়ই জাদুর শহর শব্দটা খুব একটা উচ্চারিত হয় না।'

নিজের বন্ধু এবং সহকর্মীদের মাঝেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে এই 'জাদুর শহর' নিয়ে। যদি ঢাকা শহরের কথাই বলি, এখানে রেস্তোরাঁ, কফিশপ থেকে শুরু করে আনাচে-কানাচে শপিং মলের অভাব নেই। যে ধানমন্ডি লোকালয়ে বেড়ে উঠেছি, সেই শান্ত আবাসিক রাস্তাগুলোই এখন অপরিচিত ঠেকে। আধুনিক উজ্জ্বল আলোর মাঝে এই লোকালয়ের ক্ষয়িষ্ণু চেহারাটাও চাইলে সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরোখ করা যায়! যদিও এই ক্ষয়িষ্ণু শব্দ নিয়ে ভিন্ন মত আসতে পারে। এত আধুনিকতা, প্রযুক্তির ভিড়ে পুরাতনকে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ থাকলেও সেই চিন্তা কোথায়? 

তবে প্রশ্ন করতেই হয়, যে হারে অলি-গলিতে 'আধুনিকতার' রেস্তোরাঁ, ফ্যাশন ব্রান্ড-বিলবোর্ড, সুপারশপ গড়ে উঠেছে, সেই পরিমাণে লাইব্রেরি, পরিছন্ন উদ্যান গড়ে ওঠেনি। মননশীল মানুষ হিসেবে সৃজনশীল চিন্তা এবং নানা চেতনা নিয়ে প্রশ্ন করবার শুরুটা তো হয়ই এই পাঠাগারে।

এ ছাড়া নানান সমস্যায় জর্জরিত এই শহর। বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে এই শহর অন্যতম— প্রায় প্রতি বছরই এই তালিকায় শীর্ষে থাকে। আমরা কোভিডের মতো অতিমারির সঙ্গে পেরে গেলেও ডেঙ্গুর সঙ্গে পেরে উঠছি না! এই শহরের অধিকাংশ ভবন, দোকানপাট অপরিকল্পিত। আমরা হয়তো তথাকথিত আধুনিকতার স্রোতে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক বা রেস্তোরাঁর খদ্দের হয়েছি কিন্তু মানুষের মন আর তার বিবেককে বিকাশের জন্য আমাদের বইঘর বা লাইব্রেরিগুলো বরং বন্ধ হয়ে গেছে!

এত কিছুর দোলাচালে আমার 'বেমানান' উত্তর আর বাদবাকিদের 'মানানসই' উত্তরটির মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন মাস্টার্স করছি, আগামীতে পিএইচডি যাত্রার পরিকল্পনা আছে। তাই এই সময়টা একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, যে কি না খুবই হোমসিক এবং একই সঙ্গে নিজের শত নবীন শিক্ষার্থীর বিষয়ে সংবেদনশীল; তার জন্য কিছুটা অস্বস্তিদায়ক বটে। প্রায়শই মনে হয়, এখানকার স্থানীয় যেসব শিক্ষার্থী, তাদের এই পিছুটানটা নেই। নিজ দেশ ছেড়ে পরবাসে নতুন করে নিজেকে পরিচিত করবার, নতুন মাটিতে প্রিয় মুখগুলোকে ছেড়ে শেকড় গড়বার দায়টা বেশিরভাগেরই নেই। অনেক সুযোগ আছে, আছে পরমতসহিষ্ণুতা।

একই সঙ্গে ভাবি নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের কথা। যাদের পড়িয়েছি শ্রেণিকক্ষে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে জানবার যে জগত, যাদের সঙ্গে খুব সহজেই আলোচনা করতে পেরেছি! এই নবীন শিক্ষার্থীরা এখনো আশার সঞ্চার করে। বিভিন্ন অন্যায় ও দাবি-দাওয়ায় এই শহরের রাজপথে আমার এই শিক্ষার্থীরাই প্রতিবাদ করে। ক্লাসরুমের শান্ত, অমনোযোগী মুখগুলোই তখন বেশ শক্ত-সামর্থ্য মানুষের রূপ নেয়। হয়তো এসব 'ক্ষুদ্র' বিষয়কে কেন্দ্র করে এখনো নিজের 'বেমানান' সিদ্ধান্তের পক্ষেই যুক্তি টানি। কেন না দিন শেষে আমরা প্রত্যেকেই জয়ী এবং প্রত্যেকেই নিজ যুক্তি, বিশ্বাসগুলোর প্রতি শান্তিপ্রিয়। 

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

15h ago