অস্ট্রেলিয়ায় ভালো নেই বাংলাদেশি শরণার্থীরা
অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ২ হাজারের মতো বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থী রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এরা পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে সেখানে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন।
পৃথিবীর যে সব দেশ মানবাধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় প্রদান করে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার শরণার্থী কাউন্সিলের মতে, দেশটিতে বর্তমানে ৭০ হাজারেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী রয়েছেন। ফেডারেল সরকার এদের জন্য এখনো স্থায়ী ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি। এই শরণার্থীদের অধিকাংশই মালয়েশিয়া, চীন, ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছেন।
এদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ শরণার্থীকে সরকার 'সুরক্ষিত' হিসেবে বিবেচনা করে। তারা সরকারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পান। তবে তার পরিমাণ খুবই সামান্য। একজন ব্যক্তির জন্য দিনে সর্বোচ্চ ৪২ ডলার বরাদ্দ আছে। অস্ট্রেলিয়াতে শরণার্থীদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার সব থেকে নিচে।
২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়া একটি নীতি গ্রহণ করেছিল। ওই নীতি অনুযায়ী, নৌকায় আগত কোনো শরণার্থীকে অস্ট্রেলিয়ায় কখনই বসতি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে না এবং সেই নীতি আজও বহাল রয়েছে।
১ হাজারেও বেশি বাংলাদেশি নৌকায় চড়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন বলে বিভিন্ন মাইগ্রেশন এজেন্টের দেওয়া তথ্যে জানা যায়। এদের বেশিরভাগই দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং পাপুয়া নিউগিনি থেকে সেখানে গেছে।
অভিযোগ আছে, অনেক রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে প্রতারণা করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বাংলাদেশি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করেছেন। একজন রোহিঙ্গার জন্য তার নিজের দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করা খুবই কঠিন।
'অ্যাসাইলাম সিকার রিসোর্স সেন্টার' জানিয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সামাজিক সহায়তা পরিষেবা হ্রাস করা হয়েছিল। ২০১৭-২০১৮ সালে যা ছিল ১৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার ২০২১-২০২২ সালে তা কমিয়ে করা হয় ৩৩ মিলিয়ন ডলার।
সেই সময়ে কোয়ালিশন সরকার কাজের অনুমতি দিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের উৎসাহিত করেছিল। যাদের কাজের অধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের নিজেদের খরচে চলার কথা বলা হয়েছিল।
বাংলাদেশি অধিকাংশ শরণার্থীকে সরকার 'সুরক্ষিত' হিসেবে বিবেচনা না করায় তাদের কাজের অনুমতি দেওয়া হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এরা 'ক্যাশ ইন হ্যান্ড' কাজ করে কোন রকমে জীবন নির্বাহ করেন। এদের বেশির ভাগই কাজ করেন রেস্টুরেন্টে অথবা বাড়ি তৈরির কোম্পানিতে। যেহেতু তাদের কাজের কোনো অনুমতি নেই, তাই তাদের কাজ করতে হয় খুবই কম বেতনে। অনেক শরণার্থী উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও কাজের অনুমতি না থাকায় বছরের পর বছর নিম্নমানের কাজ করতে হচ্ছে।
নতুন লেবার সরকারের সবশেষ বাজেটের পরিসংখ্যান দেখায় যে আশ্রয়প্রার্থীদের সহায়তা প্রদানের জন্য ৩৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এক দশক আগে ফেডারেল সরকার এই ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল।
অস্ট্রেলিয়াজুড়ে আশ্রয়প্রার্থী এবং উদ্বাস্তুদের আবাসন, আর্থিক সাহায্য, ইংরেজি ক্লাস, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার জন্য প্রায় ১৫০টি বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। এরা জনসাধারণের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে থাকে।
এই সংস্থাগুলো অস্ট্রেলিয়ার ৭০ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর মধ্যে আনুমানিক ১০ হাজার জনকে সাহায্য করছে। মূলত যারা সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না তাদের দৈনিক মৌলিক চাহিদা মেটাতে এরা কাজ করছে।
বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সংস্থাগুলোর সাহায্য তারা পাচ্ছেন না। এর মূল কারণ হিসেবে তারা বলেছেন ইংরেজি ভাষা না জানা। এইসব সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ই-মেইল। আশ্রয়প্রার্থী অনেকেই ই-মেইলে নিয়মিত যোগাযোগের ব্যাপারে পারদর্শী নন।
এ ছাড়া আরও কয়েকজন জানান, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি ঘণ্টা কাজের মূল্য ২৫-৩০ ডলার। সেখানে এরা প্রতিদিন মাত্র ২১ ডলার পান। এই সামান্য ডলারের জন্য তাদের প্রতি সপ্তাহে ব্যক্তিগত অনেক ব্যাপারে রিপোর্ট করতে হয়। যা তারা করতে চান না।
অস্ট্রেলিয়ায় কতজন আশ্রয়প্রার্থীকে কাজের অধিকার দেওয়া হয়েছে তার বিশদ বিবরণ অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র দপ্তর কখনো প্রকাশ করে না। তারা জানিয়েছে, বিভাগীয় কর্মকর্তারা কাজের অধিকার নির্ধারণ করার সময় অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করে।
এসবিএস নিউজ স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয়প্রার্থীদের দেওয়া আর্থিক সহায়তা, যোগ্যতা এবং বেতনের হার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল।
বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ান সরকার উদার এবং নমনীয় মানবিক কর্মসূচির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
স্বরাষ্ট্র বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪২৭ জন আশ্রয়প্রার্থীকে আয় সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শরণার্থী জানিয়েছেন, তাদের দুর্বিষহ জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন। কোনো রকমের কোনো তথ্যগত সহযোগিতা তারা সেখান থেকে পান না। অনেক সময়ই আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে দায়ের করা অভিযোগের স্বপক্ষে এমন কিছু তথ্য প্রমাণ ইমিগ্রেশনে দিতে হয় যা হাইকমিশনের মাধ্যম ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়।
জাহাঙ্গীর আলম সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে আছেন বেশ কয়েক বছর। তার এবং তার স্ত্রীর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তার মেয়াদ বাড়াতে তারা ক্যানবেরাতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যান। সেখান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানো হবে না কারণ তারা 'দেশবিরোধী।'
এ ব্যাপারে একজন সাংবাদিক নেতা এই বক্তব্যের চ্যালেঞ্জ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়। বিষয়টি বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করলে হাইকমিশন থেকে কমিউনিটির বিশিষ্টজনদের কাছে একটি ই-মেইল পাঠিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে। সেখানে বলা হয়, 'বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশে তার জীবন নিরাপত্তাহীন বলে প্রমাণ না হলে এখনই আশ্রয় চাওয়া যাবে না। আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে তাদের অবশ্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে হেয় করার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে, যাতে তাদের আশ্রয়ের মামলার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা যায়।'
ই-মেইলে আরও বলা হয়, তারা বাংলাদেশের জন্য একটি ভুল ভাবমূর্তি তৈরির অংশ এবং সম্প্রসারণ করে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। আমরা কয়েক বছর ধরে আশ্রয়প্রার্থীদের পাসপোর্ট দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি এবং আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন বিভাগ (ডিআইপি) এ বিষয়ে অবগত।'
আশ্রয়প্রার্থী কয়েকজন বাংলাদেশি অভিযোগ তুলেছেন কতিপয় অসাধু বাংলাদেশি মাইগ্রেশন এজেন্টের বিরুদ্ধে। তাদের বক্তব্য, ওই এজেন্টগুলো ডলারের লোভে বছরের বছর মামলাগুলো ঝুলিয়ে রাখে। তাদের প্রতি মাসে বেতন দেওয়ার মতো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আশ্রয়প্রার্থী বলেছেন, তার কাজ করার অনুমতি নেই অথচ তিনি কাজ করছেন। এটি তিনি করছেন বেঁচে থাকার তাগিদে। ইমিগ্রেশন বিভাগ এটি জানতে পারলে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠাবে। এই সুযোগটি নিচ্ছে তার মাইগ্রেশন এজেন্ট। তাকে মাঝে মধ্যেই হুমকি দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। এই ভয়েই তিনি ওই এজেন্টকে বেতনের একটি অংশ নিয়মিত দিয়ে থাকেন। ওই আশ্রয়প্রার্থীর ভাষ্য মতে, বেশ কয়েকজন নারী আশ্রয়প্রার্থীকে প্রায়ই দু একজন মাইগ্রেশন এজেন্টের অপ্রীতিকর প্রস্তাবের মুখোমুখি হতে হয়। কয়েক মাস আগে একজন এজেন্টের ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেখানে শোনা যাচ্ছে, ওই এজেন্ট একজন নারী আশ্রয়প্রার্থীকে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার জন্য অপ্রীতিকর প্রস্তাব দিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও বাংলাদেশের মূলধারার কয়েকটি গণমাধ্যমে ফোনালাপটি প্রচারিত হয়।
অস্ট্রেলিয়া সরকার গত মাসে ইঙ্গিত দিয়েছে, অস্থায়ী সুরক্ষা ভিসা এবং নিরাপদ আশ্রয় ভিসায় ১৯ হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে এ বছরের শুরু থেকে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেওয়া হবে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলনের অধিকারও দেওয়া হবে।
আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
Comments