শুভ্র তুষারের দিন

ছবি: নাদিয়া রহমান

ছোটবেলায় টেলিভিশনে বিভিন্ন দেশের তুষারপাতের ছবি দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম, আমাদের দেশে কেন তুষার পড়ে না। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভাবনা-চিন্তা পাল্টে গেছে পুরোদস্তুর। 

শীতের দিনে খুব ভোরে উঠে অফিসে যাওয়ার কারণেই মূলত। মনে হতো, দেশের এটুকু শীত সহ্য করতেই কষ্ট হয়, তুষারপাত সেক্ষেত্রে সহজ বিষয় নয়। তাই দেশে পুরো বছরই গ্রীষ্ম নিয়ে অনেকের নানা অভিযোগ থাকলেও আমি গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ হিসেবে সর্বদাই সন্তুষ্ট। কেননা দাপ্তরিক কাজ সেরে দিনের একটা দীর্ঘসময় হাতে থেকে যায় অন্যান্য কাজের জন্য। 

ষড়ঋতুর এই দেশ- যার পুরোটাই বলা চলে গ্রীষ্মকাল, তা ছেড়ে আমাকে পড়তে আসতে হলো উত্তর আমেরিকায়। তা-ও ভালো এই যাত্রায় কেন্টাকির লেক্সিংটন শহরে পড়াশোনা করছি। সবাই বলে এখানে তুলনামূলক তুষারপাত অনেক কম। তবে তাপমাত্রা মাইনাস ১৭ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কখনো আরেকটু সহনীয় মাইনাস ১১ ডিগ্রিতে ওঠানামা করে। 

আর যখন তুষারপাত শুরু হয়, পুরো প্রকৃতিটাই অন্ধকার, বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে নাকি জরুরি-ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, ল্যাব, বাস সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি এসে এমনটা না দেখলেও সকালের ক্লাস, দাপ্তরিক কাজ বন্ধের ঘোষণা শুনেছি প্রায়ই। কখনো কখনো এমনও হয় যে, আমরা শিক্ষার্থীরাই প্রার্থনা করি, আরও তুষারপাত হোক। ক্লাস, অফিস, ল্যাবরেটরি সব বন্ধ করে দিক। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই শ-খানেক ইমেইল পাই। সবারই প্রশ্ন, 'আজকের ক্লাসটা কি হচ্ছে?'। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, বাজারটা তাহলে কীভাবে করা হবে? গাড়ি চলাচলও তো বন্ধ হয়ে যায়। সারারাত বরফ গলার জন্য পুরো রাস্তায় লবণ ছিটিয়ে দিলেও তো কাজ হবে না। 

তুষারপাতকে যতটা আমুদে মনে হতো ছোটবেলায়, আসলে ততটা নয়। বিশেষ করে, আমরা যারা এশিয়ার উষ্ণ অঞ্চলের মানুষ। এখানকার মানুষকে দেখি এই তুষারেও তেমন ভারী কাপড় না পরেই দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। বোঝাই যায়, আমার জিনে এই বৈশিষ্ট্য নেই। আদিপুরুষ থেকেই আমাদের জিন তুষারকে প্রতিকূল হিসেবেই জেনে এসেছে। তারপরও যে তুলার মতো পুরু ইঞ্চি খানেক জমে থাকা বরফে হেঁটে ক্লাস করি, ক্লাসে পড়াই, বাজার-সদাই করি, নিজেকে একটু মনযোগী এবং উদ্যমী হিসেবে বাহবা দেওয়াই যায়। 

এখানকার স্থানীয়রা যেমন এই আবহাওয়া এবং তাকে নিজের বশবর্তী করার বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করেছে, সেগুলো আমাদের জন্য একটু ভিন্ন। আমাদের এগুলো শিখে নিতে হয় এবং তার চেয়ে বেশি মানিয়ে নিতে হয়। 

অনেক সহপাঠীই বলেন, দুপুরের পরেই যে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে, এটা তাদের মানসিক বিষণ্ণতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেই খেয়াল করেছি, বাস স্টপেজে যে শূন্য, পাতাবিহীন, রুক্ষ গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, সেগুলো গ্রীষ্মেই না কতটা প্রাণবন্ত ছিল। এমনকি শরতে পাতা ঝরার মৌসুমেও। 

গ্রীষ্মে হেঁটে আড্ডা দিতে চলে গেছি বিভিন্ন বন্ধুর বাসায়, এখন এই তুষারের কারণে বন্দী হয়ে থাকতে হয় ডর্মে। শুধু জানালা দিয়ে নিজের মতো করে তুষারপাত দেখা। কখনো জানালার ধারে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। তখন মনে হয়, ছোটবেলায় এই তুষার নিয়ে কত আক্ষেপই না করেছি। এখন যখন তুষার দেখছি তখন মনে পরছে আবার বাড়ির কথা, কী মুশকিল! 

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English

BNP won’t tolerate extortionists, grabbers: Rizvi

Attempts are being made to create chaos in the society in the name of "mob culture", says the BNP leader

20m ago