উচ্চশিক্ষায় ভাষার দেয়াল ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত

ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকি। ছবি: নাদিয়া রহমান

যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসবার পর প্রথম কয়েক মাস লেগেছিল এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে 'স্বাভাবিক' যোগাযোগ করতে। সেই ছোটবেলায় ইংরেজি শিক্ষার হাতেখড়ি হলেও একেবারে পশ্চিমে না আসা পর্যন্ত বোঝা সম্ভব হয়নি; স্থানীয়দের উচ্চারণ, ভাষার অর্থ কত ভিন্ন হতে পারে।

ক্লাসে লেকচার তো ঠিকই বুঝতাম, তবে সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপে কিংবা কোনো আয়োজনে যেখানে আনুষ্ঠানিকতার ধার কেউ ধারে না, সেখানে আড্ডা বা গল্পের সময় পার্থক্যগুলো বেশ বোঝা যেত। প্রথমদিকে মনে হতো, এত গ্রামার, নিয়ম শেখা একেবারেই বৃথা। কেন না একেক লোকালয়ের উচ্চারণ, বচনভঙ্গি যে আলাদা হবে এটা অকাট্য সত্য।  

তবে এ নিয়ে এখানকার কারও মধ্যে কোনো সংকোচ বা মাথাব্যথা দেখিনি। না অধ্যাপক, না আমার আমেরিকান সহপাঠী। এমনকি আমার দেড়শ শিক্ষার্থীর মধ্যেও না। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ তুলনামূলকভাবে তাও বেশ ভালো ইংরেজি রপ্ত করি। বিশেষ করে বলবার ক্ষেত্রে, কীভাবে সূক্ষ্ম স্যাটায়ার যোগ করে, কখনো ভারী বাক্যকে হাসির ছলে সংক্ষেপে বলে দেওয়া। বেশি দুর্বোধ্য ঠেকে পূর্ব এশিয়ার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষকদের ইংরেজিকে।

মাঝে মধ্যে ভাবনায় পড়ে যেতাম, ক্লাসে এদের লেকচার শিক্ষার্থীরা বোঝেই বা কীভাবে! তবে যা বলছিলাম, এ নিয়ে এখানকার কারও তেমন মাথাব্যথা নেই। যোগাযোগ হলেই হলো। তুমি যে চেষ্টা করছো, সেটা আসল কথা।

মূল কথা হলো, ছোটবেলা থেকে আমরা যে হীনম্মন্যতায় বড় হই, ইংরেজি ভালোভাবে বলতে না পারার কারণে কিংবা একমাত্র এই ভাষাজ্ঞান দিয়েই নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে জাহির করবার যেই বিষয়টা চলমান, সেটা এখানকার স্থানীয়দের মধ্যেই নেই। এমনকি চীন কিংবা কোরিয়ার মানুষদের এখানে দেখেছি, ইংরেজি খুব নির্ভুলভাবে রপ্ত করতে না পারায় তাদের কোনো দ্বিধা নেই। বরং ক্লাসের শুরুতেই কোনো ভণিতা ছাড়া খুব সরলভাবে স্বীকার করে নেয় যে 'ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়। আমি আমার মাতৃভাষাতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করি'। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী, সবার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্লাসের পড়া এবং পড়ার যত গবেষণাপত্র সেগুলো ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারছে কি না।

হ্যাঁ, একটা বিষয় তো থাকেই। যদি অধ্যাপকের সঙ্গেই পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা না গেল তাহলে কীভাবে হবে? কিংবা এখানে অনেক আলোচনা করতে হয় ক্লাসে। ভালো বলতে না পারলে নিশ্চয়ই কিছুটা খারাপ লাগে। সেজন্যও আমার অনেক আফ্রিকার সহপাঠীদের দেখেছি, শুরুতেই স্বীকারোক্তি করে নিতে যে আমি এখানকার স্থানীয় নই। কারও বুঝতে সমস্যা হলে আমাকে আবার জিজ্ঞেস করো। কিংবা ই-মেইলে চাইলেই কেউ সেই বিষয়ে প্রশ্ন লিখে পাঠাতে পারে। একজন পূর্ব এশিয়ার অধ্যাপককেও দেখেছি, স্থানীয় শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন যখন বুঝতে পারছিলেন না, তিনি সরল অভিব্যক্তি নিয়েই বলেছিলেন, তাকে প্রশ্নগুলো লিখে দিতে। শিক্ষার্থীরাও এ নিয়ে কোনো বিদ্রূপ করেনি। যেহেতু অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী থাকেন তাই ক্লাসের পরিবেশটাই থাকে নানা সংস্কৃতির, অনেক বৈচিত্র্যের।

আমার একজন ইতালির শিক্ষক আছেন, যিনি দীর্ঘ সময় এখানেই উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু উনার ইংরেজি ভাষা একান্তই ইতালির স্থানীয়দের মতো। যা আমার মতো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের থেকেও অনেক আলাদা। মার্কিনীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। একদিন ক্লাসে উনি কথায় কথায় বলছিলেন, 'আমি তো এখানকার নই। আমার উচ্চারণ তো এমন হবে। এবং আমি এটা পরিবর্তনও করতে চাই না'। ক্লাসে উনি প্রয়োজনে একই বিষয় বারবার তুলে ধরেন যাতে কোনো শিক্ষার্থীর বুঝতে কোনো সমস্যা না হয়। ই-মেইলে প্রয়োজনীয় প্রতিটি ডকুমেন্ট উনি সিমেস্টারের শুরুতেই পাঠিয়ে রাখেন, যাতে কোথাও কোনো কিছু বাদ না পড়ে যায়।  এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য এবং কাউন্সেলিং সেন্টারগুলোয় চেষ্টা করা হয় বিভিন্ন ভাষা অন্তর্ভুক্ত করতে, যাতে একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী তার নিজ মাতৃভাষায় স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে পারে।
 
তাই ভাবছিলাম, আমরা নিজেদের দেশে বসেই ভিন্ন একটি ভাষা রপ্ত করা নিয়ে কত শ্রম ব্যয় করি। একটু ভিন্ন আদলে বলতে শিখলে আমরা কতটা ভিন্ন ভাবি নিজেদের। অবশ্যই এই বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি এবং তার পাশাপাশি আরও একটি-দুটি ভাষা রপ্ত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নিজেদের মাতৃভাষাকে অবশ্যই অবজ্ঞা করে নয়। যে ভাষার এত সুন্দর ইতিহাস আছে, তাকে তো কোনোভাবেই তুচ্ছ করা যায় না। এবং এতে বিশেষত্বও যে কিছু নেই তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্পষ্ট।

 

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

 

Comments

The Daily Star  | English

NBR officials end strike after govt warning

Following a stern government warning and mounting pressure from the country’s top business leaders, officials of the National Board of Revenue have withdrawn their shutdown.

2h ago