ইউনিফর্মের দেশ!
ব্যাংককের সড়ক ও পরিবহন দপ্তরে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিতে গেলাম গত ৭ আগস্ট। দিনটি ছিল সোমবার। সব সরকারি কর্মচারীদের পরনে হলুদ টি-শার্ট। প্রথমে মনে হয়েছিল, এটাই বুঝি এই দপ্তরের কর্মচারীদের পোশাক। পরের দিন মঙ্গলবার দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি, একই অফিসের সবাই পরেছে গোলাপী রঙের পোশাক।
মূলত পেশার পাশাপাশি সপ্তাহের প্রতিটা দিনের জন্য যেমন রং রয়েছে, তেমনি বিশেষ দিবসের জন্যও বিশেষ ইউনিফর্ম রয়েছে থাইল্যান্ডের সংস্কৃতিতে এবং নিয়মে।
বুধবারের জন্য সবুজ পোশাক, বৃহস্পতিবারের জন্য কমলা, শুক্রবারের জন্য নীল, শনিবারের জন্য বেগুনী এবং রোববারের জন্য লাল রংয়ের পোশাক।
বিশেষত সরকারি এবং বেসরকারি অফিসগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সপ্তাহের ৫ দিন ৫ রংয়ের পোশাক সরবরাহ করা হয়।
শুধু অফিস আদালত নয়। থাইদের প্রত্যাহিক জীবনেও এই রংয়ের প্রভাব রয়েছে। যেমন- রোববার বিকেলে যারা পার্কে বা মাঠে দৌড়াতে বা ব্যায়াম করতে যান, তাদের মধ্যেও দেখা যায় লাল রংয়ের পোশাকের প্রভাব বেশি।
থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক মা এবং বাবা দিবস পালন করা হয় না। বরং জাতীয় মা এবং বাবা দিবস পালন করা হয় যথাক্রমে রাজা ও রানির জন্মদিন অনুসারে। জাতীয় বাবা দিবসের দিন পোশাকের রং হবে হলুদ এবং মা দিবসের রং নীল।
এ ছাড়া হলুদ রং যেমন রাজ্যের রং হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং লাল রংকে বিবেচনা করা হয় বিপ্লবের রং হিসেবে। তাই থাইল্যান্ডে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে, তখন এই দুটি রংয়ের পোশাক পরিধান এড়িয়ে যেতে উপদেশ দেওয়া হয়।
রাজ্যের সঙ্গে রংয়ের সম্পর্ক অনেকটাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই প্রয়াত রাজা ভূমিবলের মৃত্যুর পর এক বছরের শোক পালন করা হয়েছিল এবং মানুষ যথাসাধ্য কালো পোশাক পরার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া রাজ্য থেকেও কালো রংয়ের পোশাক পরার জন্য বলা হয়।
পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ করে থাইল্যান্ডের উচ্চ শিক্ষার্থীরা এখন আর ইউনিফর্ম পরতে চান না। কারণ স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অন্তত নিজেদের পছন্দের পোশাক পরতে চান। তবে থাই সংস্কৃতিতে এই ইউনিফর্ম স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েও শেষ হয় না। বরং চাকরি জীবনেও বয়ে বেড়াতে হয়। যেমন এখানে চিকিৎসক বা আইনজীবীদের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্যও রয়েছে ইউনিফর্ম। সোমবার তাদের পরতে হয় খাকি রংয়ের সরকারি ইউনিফর্ম। রোববার ও সোমবার পরতে হয় ওই দিনের রং অনুযায়ী শার্ট বা টি-শার্ট। তবে শিক্ষিকাদের সব সময় পেন্সিল স্কার্ট পরতে হয়। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষার্থী সবাইকে বৃহস্পতিবার স্কাউটের ইউনিফর্ম এবং শুক্রবার থাই কাপড় দিয়ে বোনা নিজস্ব পোশাক পরে স্কুলে যেতে হয়।
থাই ছাত্রদের প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক (দ্বাদশ শ্রেণি) পর্যন্ত সাদা শার্টের সঙ্গে হাঁটু পর্যন্ত নেভি ব্লু রংয়ের হাফ প্যান্ট ইন করে পরতে হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে গেলে ইচ্ছানুযায়ী এবং প্রতিষ্ঠানভেদে ফুল প্যান্ট পরা যায়। তবে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও হাঁটু পর্যন্ত বা শর্ট স্কার্ট পরতে হবে।
এ ছাড়া সবাইকে এই পোশাকের সঙ্গে ফিতার শু ব্যবহার করতে হয়। এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আলাদা করে বোঝার জন্য পকেটে ব্যাজ থাকে। এ ছাড়া কাঁধের ব্যাজ এবং টাইয়ের রং দেখে বোঝা যায় কোন শ্রেণিতে পড়ছেন ওই শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষত ছাত্রীদের এই পোশাককে অনেকেই আবেদনময়ী হিসেবেও মন্তব্য করেছেন। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দেশটিতে ঘুরতে আসা চায়নিজ পর্যটকরা যখন থাই ছাত্রীদের পোশাক কিনতে ভিড় করল বা পোশাক পরে ছবি তুলতে শুরু করল, তখন এই আলোচনা আরও বেগ পেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দখল করে নিল চায়নিজ পর্যটকদের থাই ছাত্রীদের পোশাক পরা ছবি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো থাইল্যান্ডে বাস চালক এবং সহকারীর নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম রয়েছে। এ ছাড়া ট্যাক্সিচালক, হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারী, সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, সবারই আলাদা আলাদা পোশাক রয়েছে।
থাইল্যান্ডের পথে ঘাটে হঠাৎ হঠাৎ নৌবাহিনীর পোশাক পরা ব্যক্তিদের দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগে! পরে অবশ্য জানতে পেরেছি, এ ধরনের শোল্ডার, ডাবল পকেটওয়ালা সাদা ইউনিফর্ম মূলত সরকারি বড় কর্মকর্তাদের পড়তে হয়, বিশেষ বিশেষ দিনে। রাজ্য সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠান বা বিশেষ আয়োজনে তাদের এমন সাদা ইউনিফর্ম পরতে হয়।
এ ছাড়া মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরাও এই সাদা ইউনিফর্মের বাইরে নয়।
থাইল্যান্ডের এই ইউনিফর্ম নিয়ে এখন চলছে বিতণ্ডা, বিশেষত শিক্ষার্থীদের মধ্যে। মানবাধিকার কর্মীদের মতে এই পোশাকের বাধ্যকতা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব পছন্দ তৈরিতে বাধা দিচ্ছে। যার প্রভাব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পরবর্তী সময়েও জনগণকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তবে আরেকটি অংশের বিশ্বাস, শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং চর্চা করতে এ ধরনের ইউনিফর্মের ভূমিকা রয়েছে।
মাজেদুল নয়ন: থাইল্যান্ড প্রবাসী।
Comments