রংপুর করোনা হাসপাতালে ‘আইসিইউতে কোনো বেড ফাঁকা নেই’
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল রোগী দ্বারা ইতোমধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে সুযোগ থাকছে না নতুন রোগী ভর্তি করার। গড়ে প্রতিদিন ১২ জনের বেশি রোগী ভর্তি হওয়ায় হাসপাতালটিতে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি ফাঁকা নেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও (আইসিইউ)।
১০টি আইসিইউ বেড নিয়ে ১০০ শয্যার এ হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে মাত্র আটটিতে ভেন্টিলেটর সুবিধা আছে। বর্তমানে সেখানে আইসিইউ বেড খালি নেই উল্লেখ করে বাইরে নোটিশ টানিয়ে রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
আজ শনিবার সকালে রংপুর সদর হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের প্রবেশপথে টানানো রয়েছে নোটিশটি। এ নোটিশের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এস এম নুরুন নবী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভেন্টিলেটর সুবিধা সম্বলিত আটটি আইসিইউ বেডের একটিও ফাঁকা নেই। বরং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৮৫ জন রোগীর মধ্যে আরও ১৫-২০ জনকে আইসিইউতে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু, বেড ফাঁকা না থাকায় সংকটাপন্নদের চিকিৎসার বিষয়ে শঙ্কিত রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকরা।
প্রতিদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকায় আইসিইউ বেড পেতে রোগীর স্বজনদের ছুটোছুটি বাড়ছে। মাত্র ২৬টি আইসিইউ বেড দিয়ে বিভাগের আট জেলার মানুষের করোনা চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিনতলা বিশিষ্ট ১০০ শয্যার রংপুর শিশু হাসপাতালটিকে ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে দুর্যোগকালীন সময়ে ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালটি নির্মাণের পর দীর্ঘদিন ধরে উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছিল।
প্রথম ধাপে এই হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেড ও ১০টি ভেন্টিলেটর দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। উদ্বোধনকালে বলা হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে তা ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হবে। কিন্তু, বছর পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালটিতে আর আইসিইউ বেড বাড়ানো হয়নি। বরং দুটি ভেন্টিলেটর অচল হয়ে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে।
চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে রোগী ভর্তির চাপের কারণে। এই হাসপাতালে রোগীদের গ্রিন জোন, রেড জোনসহ পৃথক পৃথক জোনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক নুর-ই সাবা আশা জানান, করোনা ডেডিকেটেড আইসোলেশন হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হলেও সেখানে অক্সিজেন পোর্ট ১০০ শয্যার নয়। আরও আইসিইউ বেড বাড়ানো প্রয়োজন। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স এবং ডেডিকেটেড ওয়ার্ডবয়, ক্লিনারের অপ্রতুলতা রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রোগীর চাপে এখানকার প্রত্যেক চিকিৎসকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের আওতায় এখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের টেলিমেডিসিনে বাসায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অথচ আগে আমরা তাদের হাসপাতালেই ভর্তি করাতাম। বর্তমানে আমার মতো ৩৫-৪০ জন চিকিৎসক টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছেন।’
আইসিইউ বেডের সংকট নিয়ে করোনা ডেডিকেটেড আইসোলেশন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক এস এম নুরুন নবী জানান, ১০০ শয্যা (আটটি আইসিইউ) বিশিষ্ট রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে বর্তমানে ৮৫ জন রোগী ভর্তি আছেন। দৈনিক গড়ে ১২ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ভর্তির প্রবাহ না কমলে আগামী দু-একদিনের মধ্যে সব শয্যা পূর্ণ হয়ে যাবে। আর কোনো শয্যা খালি থাকবে না।’
এই সংকট সমাধানে খুব দ্রুত রোগী ভর্তির বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের আট জেলায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষের জন্য আইসিইউ বেড আছে মাত্র ৪৬টি। এর মধ্যে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ১০টি (সচল আটটি, দুটি অচল), রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ২০টি, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে ১৬টি বেড। এসব হাসপাতালে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকেই শয্যা বাড়ানোর কথা থাকলেও তা আর হয়নি।
বর্তমানে রংপুর ও দিনাজপুর ছাড়া বিভাগের বাকি ছয় জেলা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বহুবার আশ্বাস দেওয়া হলেও আইসিইউ শয্যা স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয় দফায় দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেলে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু, সংকট সমাধানে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার আগেই করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে পুরো রংপুর বিভাগ।
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবু মোহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিভাগে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সংক্রমণের হার ৪০ শতাংশের ওপর। করোনাভাইরাস শনাক্তের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত রংপুর বিভাগে এক লাখ ৫৮ হাজার ১৩৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে ২৭ হাজার ১৬০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৫৩৭ জন।’
তিনি আরও বলেন, ‘রংপুর বিভাগে করোনাভাইরাস সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগীকে আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলার বিকল্প নেই। তবে, আমরা আইসিইউ সংকট মোকাবিলায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
বর্তমানে রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরে। এরপর রংপুর ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ঠাকুরগাঁও।
Comments