সরকারি হাসপাতালে ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পান

সরকারি হাসপাতাল থেকে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পান এবং ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয় এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।

আজ রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টার কনটিনেন্টালে আয়োজিত এক কর্মশালায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব আলী নূর এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল। আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশীদ আলম এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু।

এসময় গবেষণাপত্রের অবহিতকরণের ওপর দুটি উপস্থাপনা প্রদান করা হয়। বলা হয়, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার অর্থ কোনো প্রকার আর্থিক দুরবস্থায় না পড়ে সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন তার প্রয়োজন অনুযায়ী মানসম্মত স্বাস্থসেবা গ্রহণ করতে পারেন তা নিশ্চিত করা। এর তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমটি হলো, স্বাস্থ্য সেবা প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া; প্রয়োজন অনুযায়ী মানসম্মত স্বাস্থসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের কারণে সৃষ্ট আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা।

প্রথম দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে দেশে ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য সেবায় উন্নতির ফলে সূচকে দেখা গেছে অভাবনীয় সাফল্য, মিলেছে বিভিন্ন অন্তির্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বাংলাদেশ বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় ছিল ৬৪ ভাগ। ২০৩২ সালের মধ্যে এই ব্যয় ৩২ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন কৌশল: ২০১২-৩২ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে এই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ ভাগ।

এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় 'নিজ পকেট থেকে গৃহস্থালি ব্যয় সংকোচনের কৌশল' শীষক টেকনিক্যাল রিপোর্ট তৈরি করেছে। আজ সেই রিপোর্টের অবহিতকরণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল বলেন, 'অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বাজেট কম। একইসঙ্গে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জন প্রতি স্বাস্থ্য খাতে খরচ সবচেয়ে কম (৪৫ ডলার)। শুধুমাত্র সরকারি অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সমাধান সম্ভব না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের খরচ করার দক্ষতা থাকতে হবে যাতে করে বাজেট অব্যবহৃত থেকে না যায়।'

তিনি অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় দেখান, সামাজিক স্বাস্থ্য বীমার প্রচলনের মাধ্যমে চীন, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বহু দেশ তাদের স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় কমিয়ে এনেছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যা একটি কার্যকরী পদ্ধতি হতে পারে। ওওপি কমিয়ে আনতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকে আরও শক্তিশালী করার দিকে জোর দিতে হবে।

সুব্রত পাল আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের তথ্য মতে দেশের সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধ কিনতে। ফলে এ ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দেশের ওওপি কমিয়ে আনবে বহুলাংশে।'

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিন 'রোগী নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার জন্য উচ্চ ব্যয়ের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান' শীর্ষক দ্বিতীয় গবেষণা প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয়ের প্রধান উৎস হলো ওষুধ। এই খাতে ব্যয় প্রায় ৬৪ ভাগ। হাসপাতালে অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেওয়ার মাধ্যমে যথাক্রমে ১২ ও ১১ ভাগ ব্যয় হয়। এ ছাড়া, রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে ব্যয় ৮ ভাগ। গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথাযথ কার্যকর না হওয়ায় এবং শহর এলাকায় পর্যাপ্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না থাকায় রোগী বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণে বাধ্য হন। তা ছাড়া, সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ ঔষধ প্রদান করা হয় না এবং রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র ৩ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে ‍ওষুধ পান এবং ১৪.৯ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে হয়ে থাকে। অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয় এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রায় সব ধরনের ওষুধ কেনার সুযোগ থাকায় এবং ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বিপণনের ফলে স্বীকৃত চিকিৎসকদের পাশাপাশি পল্লী ও হাতুড়ে ডাক্তাররাও ব্যবস্থাপত্রে অতিমাত্রায় ওষুধ লেখেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করায় রোগীর ব্যয় বেড়ে যায়। জরুরি ওষুধের তালিকা সংশোধন ও সম্প্রসারণ এবং ব্যবস্থাপত্রে প্রটোকল অনুসরণ করে কোম্পানির ওষুধের 'ব্র্যান্ড নাম' ব্যবহারের পরিবর্তে 'জেনেরিক নাম' ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে এ ব্যায়ের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।

বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাক্রিডিটেশন পদ্ধতি এবং এর সেবা মান ও মূল্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকায় সেবা গ্রহণকারী জনগণ প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সে বিষয়ে রোগীদের অসন্তুষ্টি ও কখনও কখনও আস্থার ঘাটতি তাদের দেশের পরিবর্তে বিদেশ থেকে সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করে। এভাবে চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনেক মানুষ ভিটে-জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।

রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় হ্রাস ও রোগীকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে করার লক্ষ্যে ই-হেলথ চালুর মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে সমন্বিত সেবা পদ্ধতি চালুকরণ; প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও পদায়ন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সুবিধা নিশ্চিতকরণ ও পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহের মাধ্যমে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো সক্ষমতা কাংঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীতকরণ; বেসরকারি হাসপাতালের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন পদ্ধতি চালু ও সেবার মূল্য ও মান নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি; জরুরি ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ ও সম্প্রসারণ এবং ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলককরণ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) বা সামাজিক স্বাস্থ্য বিমা চালু ও সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Domestic tourism heats up this winter

The local tourism industry was suffering from apprehension over the loss of business amid a long recession stemming from mass unrest, which began in July

2h ago