৬১ বছরে আইসিডিডিআর,বি: কলেরা থেকে করোনাভাইরাসের প্রতিকার

১৯৬১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় কলেরা মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে সেটা বিশ্বের সপ্তম কলেরা মহামারি ছিল। ওই একই সময়ে কলেরার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করতে জন্ম নেয় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।

কলেরায় মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে কমিয়ে আনার প্রায় ৬১ বছর পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি 'করোনাভাইরাস' নামে আরেক মহামারির মুখোমুখি হয়েছে।

তখন ঢাকা ছিল Dacca এবং আইসিডিডিআর,বির নাম ছিল পাকিস্তান-এসইএটিও কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি।

এসইএটিও বা সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অরগ্যানাইজেশন একটি বহুপাক্ষিক সংস্থা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশ সহ), ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য (হংকং, উত্তর বোর্ণিও ও সেরাওয়াক সহ) এবং যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৭ সালে বিলীন হয়ে যায়।

প্রখ্যাত মহামারি বিশেষজ্ঞ ফ্রেড সোপারের নেতৃত্বে আইসিডিডিআর,বির যাত্রা শুরু, যদিও তার এশিয়ায় কাজ করার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল না, এমনকি কলেরা নিয়েও বিশেষ জ্ঞান ছিল না।

অল্প সময়েই সোপার অবসর গ্রহণ করেন এবং রবার্ট এ ফিলিপ্স প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন। এরপরই কলেরার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রটি উদ্ভাবিত হয়—লবণ ও চিনির সংমিশ্রণে তৈরি একটি পানীয় লোকমুখে যা ওরস্যালাইন নামেই বেশি পরিচিত।

ফিলিপ্স প্রথম ধরতে পেরেছিলেন যে পানিশূন্যতাই কলেরার মূল সমস্যা। ১৯৭৬ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদনে জানায়, 'অন্যদের মতো রক্ত পরীক্ষা না করে তিনি বরং শত শত কলেরা আক্রান্ত রোগীর মল পরীক্ষা করেন।' এই গবেষণা থেকেই তিনি পানিশূন্যতার বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

প্রতিষ্ঠানটির বৈজ্ঞানিকরা ১৯৬২ সালের দিকে পান করার উপযোগী একটি পথ্য তৈরির কাজ শুরু করেন।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এই গবেষণার সাফল্য নিয়ে 'সহজ কলেরা চিকিৎসার জন্য একটি লবণাক্ত পানীয় প্রস্তুত করা হয়েছে' শিরোনামে ১৯৭০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

সেখানে বলা হয়, 'গবেষকরা জানতে পেরেছেন, লবণের সঙ্গে ডেক্সট্রোজ চিনি যোগ করা হলে সেই দ্রবণ থেকে শরীর খুব সহজে প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রোলাইট, যেমন: সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আহরণ করতে পারে।'

পত্রিকাটি আরও জানায়, সে সময় বিনা চিকিৎসায় কলেরা আক্রান্ত হয়ে ৮০ শতাংশ রোগী মারা যেতেন। কলেরার কারণে শরীর থেকে হারিয়ে যাওয়া তরল পূরণ করলেই এ রোগের চিকিৎসা করা যাবে, সেটা তখনো কেউ জানতেন না।

তবে ডাক্তাররা শিরাপথে দেওয়া স্যালাইন ব্যবহার শুরু করার পর মৃত্যুর হার অনেকটাই কমে যায় এবং কোনো কোনো জায়গায় তা ১ শতাংশেও নেমে আসে। কোন অঞ্চলে মৃত্যু কতটূকু কমে আসবে, তা নির্ভর করছিল সেখানে স্যালাইনের সহজলভ্যতার ওপর।

২০২১ সালে এসেও মানুষ কলেরার মতো আরেকটি ভয়াবহ মহামারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে।

আইসিডিডিআর,বিতে এ মুহূর্তে করোনাভাইরাস নিয়ে কমপক্ষে ৮৫টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা চলছে। গবেষণার মধ্যে আছে বাংলাদেশে বাদুড়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিরীক্ষা, বস্তিবাসীদের দেহে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডির অস্তিত্বের মতো বিষয়।

তবে এই মুহূর্তে আইসিডিডিআর,বির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হচ্ছে রোগীদের ওপর করোনাভাইরাস মহামারির দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব নিয়ে। এই গবেষণার গুরুত্বকে কলেরা মহামারির সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ।   

তিনি ব্যাখা করেন, 'আমরা করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার সময় রোগ পরবর্তী জটিলতা নিয়ে গবেষণা করছি। পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরনের নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা হয়নি। আমরা মৃদু, মধ্যম ও জটিল পর্যায়ের উপসর্গ আছে এরকম প্রায় ২৫০ জন রোগীর নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি। নিদৃষ্ট সময় পর পর তারা হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা তাদের মাথা থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত পরীক্ষা করি। আমরা মানসিক, মনস্তাত্বিক, স্নায়বিক পরীক্ষা করি। এ ছাড়াও, তাদের হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, যকৃত, অগ্নাশয় ও কিডনি পরীক্ষা করা হয়। আমরা এমনকি ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম ও ইকোকার্ডিওগ্রামও করে থাকি।'

গত পাঁচ মাস ধরে এই পরীক্ষা চলছে। ১৮ মাস পর্যন্ত চলবে এ গবেষণা।

তাহমিদ বলেন, 'আমরা তাদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার ব্যাপারে জানতে পারছি। অনেকেই অনিদ্রা ও ট্রমা পরবর্তী মানসিক চাপের (পিটিএসডি) অভিযোগ করেছেন। আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়, এরকম একদল সুস্থ স্বেচ্ছাসেবক নিয়েও কাজ করছি। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি তাদের মাঝেও একই উপসর্গ দেখা দেয় কী না। করোনা রোগীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।'

তিনি যোগ করেন, 'অনেকেরই হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, যেমন: পালপিটেশন, নিঃশ্বাসের সমস্যা, ইত্যাদি হচ্ছে, যার কারণে তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারছেন না। আমরা রোগীদের ডায়বেটিস পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে দেখেছি এবং তাদের অগ্নাশয় আক্রান্ত হতে দেখছি। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা সি-পেপটাইড পরীক্ষা ব্যবহার করছি।' তিনি আরও জানান, যদি এই গবেষণা ঠিকমতো শেষ হয়, তাহলে তারা কিছু সুপারিশ নিয়ে আসতে পারবেন।

এ ছাড়াও, প্রতিষ্ঠানটি ভাইরাস আক্রমণের পরে মানুষের টি-সেল কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করছে। তাহমিদ বলেন, 'আমাদের জনগোষ্ঠী ভিন্ন। আমাদের কোনো বর্ষিয়ান জনগোষ্ঠী নেই। আমাদের অনেক অনানুষ্ঠানিক নগর ভিত্তিক জনবসতি আছে যেখানে খুব সহজে সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দ্রুত তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশিরা বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ সেবন করেন এবং ভাইরাস নিরোধক ওষুধও সহজেই পাওয়া যায়। এসবের কোনো ভূমিকা আছে কী না, আমরা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।'

এই ৬১ বছরের ইতিহাসে, আইসিডিডিআর,বি কলেরার বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য অল্প কয়েকটি গবেষণামূলক পরীক্ষা থেকে দেশব্যাপী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গবেষণার কাজে অসংখ্য বৈজ্ঞানিককে নিযুক্ত করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের রস ইন্সটিটিউটের সহকারি পরিচালক ডোনাল্ড ম্যাকে ১৯৭৯ সালে লিখেছিলেন, 'ওরা সফল হয়েছে এবং এমন একটি সংগঠন থেকে এই সমাধান এসেছে, যাদের প্রতি সারা বিশ্ব চিরজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হল, কারণ তারা এমন সব প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে যার মাধ্যমে কলেরায় মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Family reunited after 18 years

Stranded in Malaysia, man finally comes back home

1h ago