বিপুল আমদানি-মজুত সত্ত্বেও চড়া চালের দাম
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে প্রচুর চাল আমদানি হয়েছে। সেই সঙ্গে কম আমদানি শুল্ক ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাসের পাশাপাশি সরকারি গুদামগুলোতে রেকর্ড মজুত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে চালের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী।
কৃষি বিপণন বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত ১১ নভেম্বর বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের খুচরা মূল্য ছিল ৪৪ টাকা থেকে ৪৮ টাকার মধ্যে। দেশের সিংহভাগ মানুষ এই চাল কেনেন। গত মে মাসে কেজি প্রতি মোটা চালের দাম ছিল ৪২ টাকা ৬৩ পয়সা। দেশের মানুষের কাছে প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত চালের এই ঊর্ধ্বমুখী দরের ভেতরেই আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত জুলাই থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ৭ লাখ ৭৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে চাল আমদানির পরিমাণ ছিল শূন্যের কোঠায়। আমদানিকৃত চালের মধ্যে সরকার এনেছে ৪ লাখ ৯৪ হাজার টন। আর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার টন।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি না হলেও রাষ্ট্রীয় গুদামগুলোতে খাদ্যের মজুত কমে আসা ও দেশের বাজারে চালের উচ্চমূল্যের কারণে পরিস্থিতির বদল ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে আমদানি বাড়াতে সরকার চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। ফলশ্রুতিতে গত অর্থবছরের শেষে চাল আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন।
সরকার এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে সরকার ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ১২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সরকার চাল কিনেছে ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন। এ ছাড়া, গত অর্থবছরের শেষের দিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ৩২০টি বেসরকারি কোম্পানিকে ১৫ লাখ ৬১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নথির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে আরও ৪১৫টি বেসরকারি সংস্থা ১৬ লাখ ৯৩ হাজার টন চাল কেনার সম্মতি পেয়েছে। ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন।
মজুমদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার চাল আমদানি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আমদানি শুল্ক কমার পাশাপাশি চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধানের কথা বলেছেন।
তার ভাষ্য, 'যদিও অক্টোবরে আগের ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক পুনঃস্থাপনের কারণে চাল আমদানি কমবে। অনেক বেসরকারি আমদানিকারক এর মধ্যেই ঋণপত্র (এলসি) বাতিল করেছেন।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার টন চাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে।
চিত্ত মজুমদার বলেন, প্রতি কেজি চালের আমদানি খরচ ছিল ৪০ টাকা। কিন্তু উচ্চ শুল্ক পুনর্বহালের কারণে স্থানীয় বাজারে তা বাড়বে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, 'চালের দাম বৃদ্ধির কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। আমদানি বেড়েছে কিন্তু যতটা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ততটা নয়।'
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান তার জন্য আমদানি শুল্ক আগের স্তরে আনা হয়েছে মন্তব্য করে খাদ্যসচিব আরও বলেন, 'দাম বাড়লে আমরা আবার আমদানি শুল্ক কমানোর কথা ভাববো।'
প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে চালের দাম কমে যাওয়ায় আমদানি বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, থাইল্যান্ড অক্টোবরে প্রতি টন চাল বিক্রি করেছে ৩৮১ ডলারে। গত বছরের একই সময়ে এর দাম ছিল ৪৫১ ডলার।
একই সময়ে প্রতি টন চালের দাম ভারতে ৩৬৯ ডলার থেকে ৩৫৯ ডলার ও মিয়ানমারে ৫২৬ ডলার থেকে ৪৪৫ ডলারে নেমে এসেছে। এ সময়ে বাংলাদেশেও ধানের উৎপাদন বেড়েছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরোর উৎপাদন গত অর্থবছরে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ কোটি ৯৯ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।
একদিকে উচ্চ আমদানি, অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে বোরো ধানের চাল কেনার পরিসর বাড়ার কারণে রাষ্ট্রীয় গুদামগুলোতে চালের মজুত নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ১০ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় গুদামগুলোতে চালের মজুত ছিল ১৩ লাখ ৭০ হাজার টন। গত বছরের একই দিনে এর পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২ হাজার টন।
১০ নভেম্বর গুদামগুলোতে চাল ও গমের সমন্বিত মজুত ১৫ লাখ ২৬ হাজার টনে পৌঁছেছে। গত জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ৮ লাখ টন।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments