দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে চাপে ভোক্তা

সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই যাচ্ছে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, চিনি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকেও একই চিত্র দেখা গেছে।

গত সপ্তাহে মিনিকেট চালের দাম প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে ৬৮ টাকা কেজি হয়েছে বলে বেশ কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা জানান।

একইভাবে, গত সপ্তাহের চেয়ে ২ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২৬ টাকায়।

তবে দ্রুত বাড়তে থাকা ভোজ্যতেলের দাম মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলছে।

খোলা সয়াবিন তেল ১৪৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৪০ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৫৫ টাকা থেকে বেড়ে প্রতি লিটার ১৬০ টাকা হয়েছে।

বিভিন্ন জাতের ডালের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

আটার দাম প্রতি কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে ৩৮ টাকা হয়েছে। একই সময়ে প্যাকেটজাত ময়দা কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকা হয়েছে।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, প্যাকেটজাত ময়দার দাম প্রতি কেজিতে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৮০ থেকে বেড়ে ৯০ টাকা হয়েছে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবু তাহের জানান, সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের স্ফীতির কারণে দৈনন্দিন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে তিনি পারিবারিক অন্যান্য খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, 'এভাবে যদি দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে, তাহলে পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।'

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চন্দন দে একই কথা বলেন।

তিনি জানান, আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই যাচ্ছে, যা খুবই হতাশাজনক।

নবজাতক শিশুর পিতা চন্দন বলেন, 'জীবনযাপনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আগামীতে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছি। কারণ বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা সাধারণত আর কমে না।'

কালশির বাসিন্দা দারুল হুদা জানান, শীতের সবজি বাজারে এলেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই।

তবে ডিম, ব্রয়লার মুরগী ও পেঁয়াজের দাম কমেছে।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগীর দাম কেজিতে প্রায় ১৫ টাকা কমেছে এবং ডিমের দাম ডজন প্রতি ১৫ টাকা কমেছে।

মুরগীর দাম কমার পেছনে কারণ হিসেবে কারওয়ান বাজারের সিদ্দিকী ব্রয়লার হাউজের মালিক আবদুল মতিন খামার থেকে সরবরাহ বৃদ্ধির কথা জানান।

মিরপুর-১১ এলাকার একটি কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতা আবিদুর রহমান জানান, দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা করে কমেছে।

দেশি পিঁয়াজের দাম এখন ৫৫ টাকা কেজি, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০ টাকা। ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে।

মিরপুরের দোয়ারিপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন জানান, পাইকারি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়েছে।

তিনি জানান, 'জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় আমরা সরকারের নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে পারছি না।'

টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স) সফিউল আতহার তসলিম স্থানীয় বাজারে চাল, ডাল, আটা ও ময়দার দাম বৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করেন।

তিনি বলেন, 'বাজার মূল্যের বর্তমান পরিস্থিতি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে পারে।'

তিনি জানান, দ্রব্যমূল্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়েছে।

বৈশ্বিকভাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চাহিদা বৃদ্ধি, মালামাল পরিবহনে খরচ বৃদ্ধি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতার কারণে বেড়েছে।

৬ মাস আগেও প্রতি টন ডালের দাম ছিল ৪৩৫ মার্কিন ডলার। যা এখন ১ হাজার ৮০ ডলার হয়েছে। একইভাবে, ময়দার দাম ২৪০ টাকা টন থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে বলে জানান তসলিম।

কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজারের বিসমিল্লাহ ট্রেডিংয়ের মালিক নুরনবী রুবেল গত ১ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ৫ থেকে ৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান। কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির হার আরও বেশি বলে যোগ করেন তিনি।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'সার্বিক বিবেচনায় সাধারণ মানুষকে বেশ ঝামেলাপূর্ণ একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীর হবে।'

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিনি সরকারকে সুষ্ঠু উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জানান, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই ধীরে ধীরে মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি তাদের জন্য বাড়তি বোঝায় পরিণত হয়েছে।'

তিনি যোগ করেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। তবে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী কর কমাতে পারে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে যেসব উপকরণ রয়েছে তা সদ্ব্যবহারের এখনই উপযুক্ত সময়।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

UK-based lawyer files complaint against Hasina, her cabinet with ICC

A UK-based lawyer has filed a complaint against former prime minister Sheikh Hasina, her cabinet and associated state actors with the Hague-based International Criminal Court, accusing them crimes against humanity

16m ago