প্রায় সব হাসপাতাল করোনা রোগীতে পরিপূর্ণ
করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সারা দেশের হাসপাতালগুলো। গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত দেশের অন্তত ১০টি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বাইরে করোনা আক্রান্ত ও করোনার উপসর্গ থাকা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব হাসপাতালের চারটি রাজশাহীতে, তিনটি চট্টগ্রামে, একটি রংপুরে, একটি খুলনায় ও একটি বরিশালে।
গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ২৬৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। চলতি মাসের প্রথম চার দিনে দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার ২৪ জন রোগী করোনা বা করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
অথচ, জুনের মাঝামাঝিতে ১৫-১৮ তারিখের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার ৬২৮ জন।
মধ্য জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ঢাকা বিভাগের হাসপাতালগুলোতে সাড়ে তিন গুণ বেশি রোগীর চিকিৎসা চলছে। একই সময়ে রাজশাহী বিভাগের ও খুলনা বিভাগের হাসপাতালগুলোতে রোগী বেড়েছে যথাক্রমে প্রায় ১৪৮ শতাংশ এবং ১৪৩ শতাংশ।
অন্যান্য বিভাগের চিত্রই প্রায় একই। প্রতিটি বিভাগে মৃত্যুও বেড়েছে।
মে থেকে জুন মাসের মধ্যে রাজশাহীতে সাপ্তাহিক মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ থেকে বেড়ে ৪৮ হয়েছিল। জুন থেকে জুলাইয়ে ১৫৭ শতাংশ বেড়ে সাপ্তাহিক মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৯ তে।
খুলনার অবস্থাও একই। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিভাগটিতে করোনা আক্রান্ত হয়ে সাত জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু, গত সপ্তাহে মৃত্যু হয় ২৫২ জনের।
বরিশালে জুনের প্রথম সপ্তাহের চেয়ে মৃত্যু বেড়েছে ৩৪০ শতাংশ। একই সময়ে রংপুরে মৃত্যু বেড়েছে ২০৪ শতাংশ। চট্টগ্রামে জুনের প্রথম সপ্তাহে ৬১ জন মারা গেলেও, ১৫৭ শতাংশ বেড়ে গত সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৯ জনে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) ৩৮৫ শয্যার কোভিড ইউনিটে গতকাল দুপুর পর্যন্ত অতিরিক্ত ৮০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। ২০টি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি ছিল না।
হাসপাতালটির চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭৫ জন রোগী যাচ্ছেন। তাদের অন্তত ৪০ শতাংশকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে আনা হচ্ছে। হাই-ফ্লো অক্সিজেন ব্যবস্থার সংকট থাকায়, এগুলো ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হচ্ছে রোগীদের।
রামেক ওয়ার্ড-৩২ এর এক চিকিৎসক জানান, গত ২৯ জুন ওই ওয়ার্ডের চার জন রোগীর হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার দরকার ছিল। কিন্তু, সেখানে ছিল মাত্র একটি।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘ওই একটি ক্যানুলাই তিন ঘণ্টা করে তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আমি। যখন এক রোগীর কাছ থেকে মেশিনটি খুলে আরেক রোগীকে দিতে যাচ্ছিলাম, তখন রোগীর ছেলে কাঁদতে শুরু করে এবং এটা না করতে অনুরোধ করতে থাকে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি আমি। কিন্তু, আর কোনো উপায় ছিল না।’
পরদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই ওয়ার্ডে আরও দুটি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করে।
রামেকে গতকাল পর্যন্ত ৬৯টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকার তথ্য জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া, জেলা পর্যায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের হাসপাতালগুলো এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আছে বাড়তি রোগীর চাপ।
রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার আরও ছয়টি হাসপাতালের প্রায় সবগুলো বেডেই রোগী ভর্তি। গতকাল দুপুর পর্যন্ত বিভাগটির ১০টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য মাত্র ১৪৭টি সাধারণ বেড ফাঁকা ছিল। ৪৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা ছিল মাত্র ১১টি।
খুলনা বিভাগে টানা সাত দিন ধরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ বিভাগের ১০টি হাসপাতালে প্রায় ৯৮০ জন করোনা রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন গতকাল পর্যন্ত। আইসিইউতে ছিলেন ৪৪ জন।
জেনারেল কোভিড ওয়ার্ডে ১৯০টি শয্যা থাকলেও কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে অতিরিক্ত আরও ৬৫ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। চারটি আইসিইউ বেডের কোনোটিই ফাঁকা ছিল না।
সাতক্ষীরা জেলা হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ৩২ দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে ১৫৯ জন মারা গেছেন।
দ্য ডেইলি স্টার দিনাজপুর সংবাদদাতা জানিয়েছেন, রোগীর চাপ সামালাতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গতকাল কোভিড-১৯ ইউনিটে শয্যার সংখ্যা ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৩১ শয্যা করেছে। সাধারণ শয্যার মধ্যে ৯১টিতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ লাইন আছে।
বিভাগীয় পর্যায়ের এ হাসপাতালটির আটটি আইসিইউ শয্যার কোনোটিই গত দুই সপ্তাহ ধরে খালি নেই। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২০ জন রোগী সেখানকার আইসিইউতে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন।
কারিগরি সমস্যার কারণে গত শনিবার হাসপাতালটিতে আধা ঘণ্টা অক্সিজেন সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় এক রোগীর মৃত্যু হয় বলে স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট নুরুন্নবী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আশেপাশের জেলাগুলো থেকে আরও রোগী আসতে থাকায় আমরা চাপে পড়েছি। বেশিরভাগ রোগীরই আইসিইউসহ জরুরি সেবা প্রয়োজন। কিন্তু, এসবের ঘাটতি আছে আমাদের।’
দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও করোনা রোগীদের জন্য শয্যার সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়তি রোগীর চাপ রয়েছে এ হাসপাতালে।
গতকাল পর্যন্ত সেখানে অন্তত ১৩০ জন করোনা রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৬টি আইসিইউ শয্যার একটিও ফাঁকা ছিল না।
রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবু মোহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রংপুর বিভাগে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বাড়ায়, শয্যার সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।
Comments