আমেরিকা থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার নেপথ্যে ৪ বাংলাদেশি-আমেরিকান

বাংলাদেশে করোনা মহামারি তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ভ্যাকসিন সংকটে বাংলাদেশ। সেই সময় আমেরিকা থেকে কোভ্যাক্সের আওতায় মডার্নার ২৫ লাখ ও ফাইজারের এক লাখ ছয় হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।
কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. চৌধুরী হাফিজ আহসান, নেফ্রলজিস্ট প্রফেসর ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ সাদেক, কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান ও সাবেক সিনিয়র ইউএন অফিসিয়াল মাহমুদ উস শামস চৌধুরী। (বাম দিক থেকে)

বাংলাদেশে করোনা মহামারি তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ভ্যাকসিন সংকটে বাংলাদেশ। সেই সময় আমেরিকা থেকে কোভ্যাক্সের আওতায় মডার্নার ২৫ লাখ ও ফাইজারের এক লাখ ছয় হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।

সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে আরও ৩০ লাখ ডোজ মডার্নার ভ্যাকসিন।

ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর, এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বিনামূল্যের এই ভ্যাকসিন পাওয়ার নেপথ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন চার জন বাংলাদেশি-আমেরিকান।

কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. চৌধুরী হাফিজ আহসান, কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান, নেফ্রলজিস্ট প্রফেসর ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ সাদেক ও সাবেক সিনিয়র ইউএন অফিসিয়াল মাহমুদ উস শামস চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফসল এই ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি।

এই চার বাংলাদেশি-আমেরিকানকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন কানাডা থেকে ডা. আরিফুর রহমান, বাংলাদেশ থেকে প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ, প্রফেসর ডা. আহমেদুল কবীরসহ আরও অনেকে।

গতকাল ও আজ একাধিকবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসানের।

তিনি বলেন, ‘প্রায় তিন মাস আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আমাকে ফোন করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৭০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্যে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু, কোনোরকম সাড়া পাচ্ছি না। খুব জরুরিভিত্তিতে আমাদের ভ্যাকসিন দরকার। আপনারা বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবে চেষ্টা করে দেখেন, কিছু করা যায় কি না।’

বাংলাদেশ যখন ভ্যাকসিন সংকটে, তখন থেকেই প্রফেসর ডা. চৌধুরী হাফিজ আহসানের নেতৃত্বে তারা কাজ করছিলেন বলে জানান প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান।

করোনা মহামারি মোকাবিলায় গঠন করা হয়েছে ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্লোবাল এক্সেস (কোভ্যাক্স)’।

কোভ্যাক্সের সদস্য দেশের সংখ্যা প্রায় ১৮১। মূলত স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে, এই লক্ষ্যেই গঠিত হয়েছে কোভ্যাক্স।

কোভ্যাক্সের আওতায় কোন দেশগুলোকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, কী পরিমাণ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী ‘ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটি’ গঠন করেছে।

প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান বলছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বাইডেন প্রশাসনের ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটিতে ঢোকা। কাজটি খুবই কঠিন ছিল আমাদের জন্যে। কমিটিতে ঢুকতে না পারলে খুব বেশিকিছু করার সুযোগ ছিল না। সিনেটর ক্যাথরিনের ব্যক্তিগত কার্ডিওলজিস্ট ডা. হাফিজ। ক্যাথরিনের মাধ্যমে আমরা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের শরণাপন্ন হই। কমলা হ্যারিস ও ক্যাথরিনের আন্তরিক সহযোগিতায় কমিটিতে ঢোকাতে সক্ষম হই প্রফেসর ডা. হাফিজকে। তিনি ভ্যাকসিন পাবে এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল না। ১৮১টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৮টি দেশের তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশও।’

কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাবে বলে জানা গিয়েছিল, এখন পাচ্ছে মডার্নার ভ্যাকসিন। বাংলাদেশের ভ্যাকসিন কেনার কথাও আলোচনায় ছিল— এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন টিমে ঢুকে আমরা কোভ্যাক্স থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি ভ্যাকসিন কেনার আগ্রহ প্রকাশ করি। তখন বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় ভ্যাকসিন কিনতে হবে না, কোভ্যাক্স থেকে প্রথম চালানে ২৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেওয়া হবে। এরপর থেকে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন পেতেই থাকবে।’

তখন তারা ১০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দিতে চেয়েছিল। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তা ধ্বংস করে ফেলা হয়, জানান প্রফেসর মাসুদুল হাসান।

তিনি বলেন, ‘সেসময় বাংলাদেশকে ২৫ লাখ ডোজ মডার্না ও এক লাখ ছয় হাজার ডোজ ফাইজারের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এখন দেওয়া হলো ৩০ লাখ ডোজ মডার্নার ভ্যাকসিন। যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে।’

‘কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ভ্যাকসিন দেওয়ার যে ১৮টি দেশের তালিকা করেছে, এবার তার মধ্যে মাত্র দুটি দেশ ভ্যাকসিন পেয়েছে। বাংলাদেশ ৩০ লাখ ডোজ আর ইউক্রেন ১০ লাখ ডোজ’, বলছিলেন প্রফেসর হাসান।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোভ্যাক্সের কী পরিমাণ ভ্যাকসিন পাবে, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘ভ্যাকসিনের আবেদনে আমরা পরিমাণ উল্লেখ করিনি। যেহেতু আমরা ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটির সদস্য, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোভ্যাক্সের আওতায় যতবার ভ্যাকসিন দেবে, ততবারই বাংলাদেশ পাবে।’

বাংলাদেশ সরকারের সূত্র বলছে কোভ্যাক্স থেকে ভর্তুকি-মূল্যে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন কিনছে, আর আপনারা বলছেন বাংলাদেশ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পাচ্ছে—এ বিষয়ে প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে এলে সাংবাদিকরা ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেসময় বলেছিলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। আমেরিকা ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলে আমাদের মুলা দেখাচ্ছে। তখন আমরা বলেছিলাম, আমেরিকা আশ্বস্ত করেছে ভ্যাকসিন দেবে। তারপর জুনে আমরা প্রথম চালান এবং দ্বিতীয় চালান পেলাম জুলাইয়ে। ভ্যাকসিনের সব যোগাযোগ হয়েছে আমাদের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশ যে ভ্যাকসিন পাচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। ভর্তুকি-মূল্যে কেনার প্রসঙ্গ আসছে না এখানে। আমাদের কাছে সব তথ্য প্রমাণ আছে।’

ভ্যাকসিনের দাম ও পরিবহন খরচের বিষয়টি নিয়ে ডা. হাসানের সঙ্গে বাংলাদেশ সময় সোমবার রাত ১০টায় আবারও কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটির সদস্য হিসেবে আমরা জানি, বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে কোভ্যাক্সের ভ্যাকসিন পাচ্ছে বিনামূল্যে। পরিবহন খরচও কোভ্যাক্স ফান্ড থেকেই বহন করার কথা। এখন পরিবহন খরচ বাংলাদেশ বহন করছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।’

বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৪০০ ভেন্টিলেটর পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন কমিটি এক হাজারটি ভেন্টিলেটর পেয়েছিল। যার ৪০০টি পেয়েছে বাংলাদেশ, আর ৬০০টি পেয়েছে ভারত। যার ১৫০টি বারডেমে পৌঁছে গেছে। বাকি ২৫০টি দিল্লি এয়ারপোর্টে আছে। বাংলাদেশ সেখান থেকে দু-একদিনের মধ্যে সংগ্রহ করবে। এক্ষেত্রে শুধু পরিবহন খরচ বাবদ প্রতিটির জন্য ১০০ ডলার করে খরচ হবে বাংলাদেশের।’

তিনি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া তালিকার অন্য ১৬টি দেশ একটি ভেন্টিলেটরও পায়নি। বাংলাদেশের ৪০০ ভেন্টিলেটর পাওয়া সম্ভব হয়েছে কমিটিতে আমাদের উপস্থিতির কারণে। মেড ইন আমেরিকা ব্র্যান্ড নিউ এই ভেন্টিলেটরের প্রতিটির দাম ১৫ হাজার ডলার। যা আমরা পেয়েছি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।’

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের উদ্যোগের কথা বলছিলেন প্রফেসর হাসান। তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছি আমরা। ইউরোপীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান আগামী অক্টোবর নাগাদ দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি।’

তিনি বলেন, ‘কেউ আমাদের কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেবে না, কিনতেও পারব না। ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে হবে। যুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন করেছি, সেই দেশের বিপদে অবশ্যই আমাদের ভূমিকা রাখতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের এই উদ্যোগ।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘের শিশু দাতব্য সংস্থা ইউনিসেফসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কোভ্যাক্স পরিচালনা করে।

এর আওতায় গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পায় ঘানা। এরপর থেকে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া ও ফিজিসহ বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশে ৮১ মিলিয়নের বেশি ডোজ বিতরণ করেছে কোভ্যাক্স। যুক্তরাষ্ট্র এতে অনুদান হিসেবে ফাইজারের ৫০ কোটি ডোজ দিচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও সুইডেন কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডোজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে বিভিন্ন দেশে টিকা বণ্টনের যে তালিকা কোভ্যাক্স প্রকাশ করেছিল, তাতে জুনের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ এক কোটি ২৭ লাখ ৯২ হাজার ডোজ কোভিড-১৯ টিকা পাওয়ার কথা ছিল। কোভ্যাক্সের এই টিকার বড় অংশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সংগ্রহ করার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কোভ্যাক্স সময়মতো টিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে বিশ্বজুড়ে সামগ্রিক টিকা পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় কোভ্যাক্স।

Comments

The Daily Star  | English

Rain brings relief to Dhaka, eases heat

A light to moderate rain drenched Dhaka this morning, providing much-needed relief from the ongoing heatwave

13m ago