দিনের শেষে ঘুমের দেশে কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদার

তরুণ মজুমদার। ছবি:সংগৃহীত

'যদি পড়িয়া মনে

ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে

তবু মনে রেখো'

বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। নীরবে নিভৃতে দিনের শেষে ঘুমের দেশে চলে গেলেন ৪টি জাতীয় পুরস্কার, ৭টি বি.এফ.জে.এ. সম্মান, ৫টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একটি আনন্দলোক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক তরুণ মজুমদার।

বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার বহুদিন ধরে কিডনির সমস্যা, ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। এই বছরের ১৪ জুন থেকে কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২ জুলাই অবস্থার অবনতি হলে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। অবশেষে ৪ জুলাই সোমবার সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পরিচালকের ইচ্ছানুযায়ী তার চোখ ও মরদেহ এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা হয়। 

তরুণ মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক তরুণ বাবুর শেষযাত্রায় তার ইচ্ছানুযায়ী বুকের ওপর রাখা হয়েছিল গীতাঞ্জলি আর সিপিএমের লাল পতাকা। ছিল না কোনো আড়ম্বরের আতিশয্য। এমনকি পরিচালক চাইতেন না তার মরদেহে ফুল, মালা কিংবা গান স্যালুট দেয়া হোক। তাই হয়নি এসবের কিছুই।

শ্রীমতি পিকচার্স থেকে যাত্রিক: প্রেরণায় উত্তম-সুচিত্রা

কাজ শেখার তাগিদে শ্রীমতি পিকচার্সে প্রায় বছর পাঁচেক শিক্ষানবিশ হিসেবে বিনা বেতনে কাজ করেছেন তরুণ মজুমদার। শ্রীমতি পিকচার্সের রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের শুটিংয়ের সময় উত্তম কুমার তরুণ মজুমদারকে বাংলা সিনেমা  পরিচালনার কথা বলেন। তরুণ বাবু পরিচালিত সিনেমায় তিনি ও সুচিত্রা সেন নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করবেন বলেও আশ্বাস দেন উত্তম কুমার। সুচিত্রা সেনও এতে আপত্তি করলেন না, বরং টাকা দেওয়ার কথা বললেন।

এভাবে সূচনা ঘটে যাত্রিক গোষ্ঠীর। তরুণ মজুমদার, শচীন মুখোপাধ্যায় আর দিলীপ মুখোপাধ্যায়—এই ৩ পরিচালক মিলে যাত্রিক গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু করেন। যাত্রিক গোষ্ঠীর ব্যানারে তৈরি হয় 'চাওয়া-পাওয়া', 'স্মৃতিটুকু থাক', 'কাঁচের স্বর্গ' ইত্যাদি চলচ্চিত্র।

উত্তম কুমারের প্রেরণায় পরিচালক তরুণের উন্মেষ ঘটলেও 'চাওয়া-পাওয়া' বাদে তরুণের পরিচালিত একক ছবিতে উত্তম-তরুণের কাজ করা হয়ে উঠেনি।  'কাঁচের স্বর্গ'তে উত্তম কুমারকে ব্যর্থ নায়কের চরিত্র দিতে চেয়েছিলেন তরুণ বাবু, রাজি হননি মহানায়ক।

উৎপল দত্তের নাটক 'টিনের তলোয়ার' নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা একবার ভেবেছিলেন তরুণ মজুমদার। এর প্রধান চরিত্রে রাখতে চেয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। এ নিয়ে মহানায়কের সঙ্গে কথাবার্তাও চলছিল। কথা হচ্ছিল প্রযোজক রামগুপ্তের সঙ্গেও। কিন্তু তরুণ মজুমদার তখন ব্যস্ত 'দাদার কীর্তি'র কাজে। এরপর ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা যান উত্তম কুমার। 'টিনের তলোয়ার' আর সিনেমা হয়ে উঠেনি।

তরুণের উত্থান: 'চাওয়া পাওয়া'

বাংলা চলচ্চিত্রে তারুণ্যের হাওয়া নিয়ে কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদারের উত্থান ঘটেছিল 'চাওয়া-পাওয়া' পরিচালনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৯ সালে নির্মিত এ চলচ্চিত্রের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন। চলচ্চিত্রটি সুপার ডুপার হিট হয়। উত্তম সুচিত্রার শেষ রোমান্টিক ছবি 'চাওয়া-পাওয়া'।

তরুণ মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

এ চলচ্চিত্রের অন্যতম ২টি বিখ্যাত গান হচ্ছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে 'যদি ভাবো এ তো খেলাঘর' এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে `এই যে কাছে ডাকা'। এ ২টি গানেরই গীতিকার ছিলেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার।

নতুন মুখের খোঁজে তরুণ

বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন মুখ অন্বেষণে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তরুণ মজুমদার। তিনি কখনই 'ফেসভ্যালু' হিসেব করে কাউকে অভিনয়ে নিতেন না। তরুণ খুঁজতেন চির তরুণদের। সন্ধ্যা রায়, অনুপ কুমার, তাপস পাল, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় জগতে দীক্ষা হয়েছিল তরুণ মজুমদারের হাত ধরে। সাড়ে ৩ বছর বয়সে 'কুহেলী' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দেবশ্রী রায়ের চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ  তরুণ বাবুর হাত ধরেই। পরবর্তীতে তিনি কাজ করেছেন 'দাদার কীর্তি' আর 'ভালোবাসা ভালোবাসা' সিনেমাতে। অনেক নতুন মুখ, নতুন কুড়িকে বিকশিত করেছিলেন এই কিংবদন্তি পরিচালক।

সাহিত্য আর ছবির মেলবন্ধন তরুণ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বিমল করসহ বহু লেখকের লেখা নিয়ে তরুণ মজুমদার তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র। মনোজ বসুর 'আংটি চাটুজ্জ্যের ভাই' গল্প নিয়ে তৈরি করেছিলেন 'পলাতক', তারাশঙ্করের উপন্যাস থেকে তৈরি করেছিলেন 'গণদেবতা', বিভূতিভূষণের গল্প অবলম্বনে 'নিমন্ত্রণ', 'কিন্নর দল' অবলম্বনে 'আলো', বিমল করের গল্প থেকে 'বালিকা বধূ', শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করে 'দাদার কীর্তি'।

তরুণ মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্য আর সিনেমার এ মেলবন্ধন সম্ভব হয়েছিল পরিচালক তরুণ মজুমদারের সাহিত্য প্রীতির কারণে। ছোটবেলায় ভারতী লাইব্রেরিতে পড়ে শেষ করেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর। পরিচালকের তখন থেকেই মনে ইচ্ছে জাগে এসব গল্প নিয়ে সিনেমা বানানোর।

রবির আলোয় তরুণ

তরুণ মজুমদারের সিনেমার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার। তরুণ বাবু বলতেন, 'রবীন্দ্রসংগীত হলো সেই স্পর্শমণি, যার স্পর্শে সবকিছু সোনা হয়ে যায়।' তার বহু ছবিতে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে রবীন্দ্রসংগীত। প্রতিটি দর্শকের কাছে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছিলেন রবির আলো।

'কুহেলী' সিনেমায় 'তুমি রবে নীরবে', 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে' আছে, 'নিমন্ত্রণ' সিনেমায় আছে 'দূরে কোথাও দূরে দূরে', 'দাদার কীর্তিতে' আছে 'যৌবন সরসীনীরে মিলন শতদল' আর 'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে'। 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' সিনেমায়  আছে 'সখী ভাবনা কাহারে বলে', 'কাঁচের স্বর্গ' সিনেমায় আছে 'দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না', 'ভালোবাসার বাড়ি' সিনেমায় আছে 'ফাগুন হাওয়ায়', 'ওগো নদী আপন বেগে', 'মোর হৃদয়ের গোপন বিজন', 'বাজিল কাহারো বীণা', 'আমার অঙ্গে অঙ্গে', 'নূপুর বেজে যায়'।

'আলো' সিনেমায় আছে 'শ্রাবণের ধারার মতো', 'আমার রাত পোহালো', 'যখন পড়বে না মোর, 'দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার'।  'চাঁদের বাড়ি' সিনেমায় আছে 'চাঁদের হাসি', 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি' প্রভৃতি রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীতকে এই পরিচালক মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাই শেষযাত্রায় 'গীতাঞ্জলিকে' ঠাঁই দিয়েছেন বুকে।

জীবনপুরের পথিক  তরুণ

জীবনপুরের পথিক, বিখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদার বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন একজন বিপ্লবী। দেশভাগের পর তারা পাড়ি জমান কলকাতায়।

তিনি প্রথমে সেন্ট পলস ও পরবর্তীকালে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। কলেজে দীক্ষিত হন বামপন্থী আদর্শে।

তরুণ মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

মোট ৩৩টি চলচ্চিত্রে পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তরুণ মজুমদার, যার মধ্যে ৩টি যৌথভাবে পরিচালিত। 'চাওয়া-পাওয়া' দিয়ে যে তরুণের শুরু, তার শেষ 'ভালোবাসার বাড়ি'তে। দীর্ঘ ৫৯ বছরের কাজ ‍দিয়ে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে।

তার পরিচালিত হিট চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'বালিকা বধূ', 'কুহেলি', 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ', 'ফুলেশ্বরী', 'দাদার কীর্তি', 'ভালোবাসা ভালোবাসা', 'আপন আমার আপন'। তবে তরুণ বাবুর নিজের কাজের মধ্যে সবচেয়ে পছন্দের ছিল 'ফুলেশ্বরী'। মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যা থেকে প্রেম-ভালোবাসা, থ্রিলারধর্মী গল্প থেকে পরিবারের গল্প কিংবা ট্রাজেডি—সবখানেই তরুণ মজুমদার অনন্য ও অম্লান।

'তুমি রবে নীরবে

হৃদয়ে মম'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago