হাসান আরিফ

অক্লান্ত এক সংস্কৃতিজন

'কেউ যায় যুদ্ধে-কেউ যায় ভিক্ষায়'। মানুষের সামনে খোলা থাকে দুটি পথ, মাঝামাঝি থাকে না কোনো জায়গা-জমিন। সহজ পথ ভিক্ষার- কঠিন পথ যুদ্ধের-সাধনা দিয়ে যে জীবনের পণ ও পথকে শানিত রাখতে হয় প্রতিনিয়ত। যুদ্ধের জীবনেও ভিক্ষুকের খাসলত উঁকি মারে। যোদ্ধাও ইহলৌকিক লোভ-লালসায় পাল্টে ফেলে মন্ত্রের সাধন। সুযোগ-সুবিধার হাতছানি-গাড়ি-বাড়ি-প্লট-ফ্ল্যাট-বিদেশ ভ্রমণ-পদ-পদবির মোহ একদা  যোদ্ধাকেও করে তোলে ভিখারি সর্দার। কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধা এসব থোড়াই কেয়ার করে মানুষের কল্যাণে-দেশপ্রেমের প্রশ্নে-অন্যায় সুযোগ সুবিধার প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত না হয়ে সংকীর্তন করে কেবলই সত্যের-নৈতিকতার-সর্বপ্রাণের মঙ্গলসাধনার-সংস্কৃতির স্বভাবজ প্রাণ প্রবাহে নিজেকে করে উৎসর্গিকৃত এক প্রাণ, হাসান আরিফ ছিলেন সেইরকম যোদ্ধার প্রতিভূ-অক্লান্ত এক সংস্কৃতিজন।

মুখ ফসকে নয়, বাস্তবিকই কখনো কখনো বলি- নিজ জন্ম শহর কুষ্টিয়ার পরই কুমিল্লায় গিয়েছি বেশি-চিনিও কিছুটা। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে, তার কিছুটা উত্তর হয়তো এরকম, শালবন বিহার, রূপবান মোড়, কৌটিল্যের মোড় আমায় ডাকে-টানে-আকর্ষণ করে দুর্ণিবার। জ্যেষ্ঠ বন্ধু মিল্কির লালমাই-ময়নামতির শহর কুমিল্লায়, সেই সূত্রেই পরিচয় উনার বন্ধু তানিম ভাই, আহসানুল কবীরসহ অনেকের সঙ্গে বিশেষ করে প্রথিতযশা আবৃত্তিকার, সাংস্কৃতিক জোটের নেতা (হাসান আরিফ) আরিফ ভাইয়ের সঙ্গেও। পরিচয় কেবলই হাই-হ্যালোর ফ্যাশনে সীমাবদ্ধ থাকেনি-আমরা হয়ে উঠেছি একে অপরের সহমর্মী-সহযোদ্ধা আর আরিফ ভাই হয়ে উঠেছেন আমাদের আশ্রয়, শিল্প-সংস্কৃতির বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞ এক নির্দেশক।

মনে পড়ে, বন্ধুরা একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করব বলে। ক্ষুদিরাম বসুর জীবন-কর্ম ও সময়কে ধরে, আত্মোৎসর্গের শতবর্ষ উপলক্ষে 'একবার বিদায় দে মা' চলচ্চিত্রের মহরত সম্পন্ন হয়েছিল। সেই কর্মযজ্ঞেরও প্রাণপুরুষ ছিলেন আমাদের আরিফ ভাই। ওই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা ব্যানার করেছিলাম-কবিতা ও উদ্ধৃতির অংশবিশেষ দিয়ে। সেখানে জনপ্রিয় একটি কবিতার প্রসঙ্গ উঠতেই আরিফ ভাই না করে দিয়েছিলেন, কারণ ক্ষুদিরাম বসুর আত্মোৎসর্গের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চেতনা তার সঙ্গে কবির অবস্থান একেবারে বিপরীতে। আরিফ ভাই ছিলেন এরকমই। আদর্শে-চেতনায় কোনো ভড়ং ছিল না। কাকে গ্রহণ করা যায়-কেনো করা যায় তা যেমন বুঝতেন পষ্ট করে-কোনো রাখঢাক ব্যতিরেকে তেমনি কাকে গ্রহণ করা যায় না-কার মানসজগতে পরিভ্রমণ করা অনুচিত-সাংঘর্ষিক সেটাও বলতেন সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে। 

আরিফ ভাইয়ের চেতনা ছিল উজান গাঙের সেই নাইয়ার মতো। যিনি সকল সময়ে সকল অবস্থানে কোনোপ্রকার আপসকামিতা ছাড়াই তরী উজানে বাইতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং আমৃত্যু অক্লান্ত এক নাবিকের মতো নিজের লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। 'একবার বিদায় দে মা' চলচ্চিত্রের সরকারি অনুদানের জন্যও আরিফ ভাই আবেদন করেছিলেন এবং বিশ্বাস রেখেছিলেন বিষয়বস্তু এবং চিত্রনাট্যের কারণেই এটি অনুদান পাবেন। তার সেই বিশ্বাস শেষাবধি সত্য হয়ে ওঠেনি ঠিকেই- কিন্তু তিনি পথচ্যুত হননি-আফসোস করেননি-অন্যকোনোভাবে হাসিল করার জন্যও চেষ্টা করেননি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আরিফ ভাইয়ের পক্ষপাত কতোটা প্রবল ও শ্রদ্ধা জাগানিয়া ছিল তা যারা তাকে কাছে থেকে দেখেছেন কিংবা আরিফ ভাইয়ের অনুপস্থিতে বিষয়টা ‍উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন-তারা বিষয়টা এখন এবং আগামিতেও মর্মে মর্মে বুঝবেন নিশ্চয়। আরিফ ভাইয়ের আবৃত্তি যারা শুনেছেন-একক আবৃত্তি সন্ধ্যার সাক্ষী রয়েছেন যারা, তারা বুঝেছেন কবিতা নির্বাচনে তার ঝোঁক ও সবল আগ্রহ মূলত কোনদিকে ছিল, কোন্ কোন্ বিষয়গুলোর প্রতি তিনি আন্তরিক-অনুরক্ত ও ‍গুণগ্রাহী ছিলেন।

হাসান আরিফ শুধুই একজন আবৃত্তিকার নন-রাজনীতি সচেতনতো বটেই ভূগোল ও ভগবান সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল এবং খাঁটি বাঙালিয়ানা বলতে যা বোঝায়, ছিলেন তাঁর প্রতিভূ ও প্রকৃষ্ট এক উদাহরণ। তার আবৃত্তির বাইরের যে জীবন- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনন্য একজন নেতা-কর্মীর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে যে হাসান আরিফ- সেখানেও তিনি শিল্পীর যে দায়-নেতার যে ভূমিকা- কর্মীর যে বান্ধব হিতৈষী মনোবৃত্তি সেটা তিনি পূরণ করে গেছেন ষোলো আনায়।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যে মৌলশক্তি, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- তা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নানাভাবেই ভাবনা-চিন্তা করতেন। কীভাবে-কোন উপায়ে স্বদেশের আবেগ-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আধার সবার মাঝে বিস্তার করা যায় তা নিয়ে ছিলেন ভীষণ কর্মোদ্যাগী এক মানুষ- যা তার সমকালে ছিল একেবারেই হাতে গোণা কিংবা অনেকোংশেই বিরল। এ লক্ষ্যে আরিফ ভাই তারুণ্য নির্ভর একটা মাল্টিমিডিয়া হাউজের কথা বলতেন প্রায়শ। যে প্রতিষ্ঠান মুনাফা করবে আবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণেও যুৎসই ভূমিকা পালন করবেন- যার মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্ম বাঙালিত্বকে-মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে-বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করতে শিখবে।

মনে পড়ে, এসবের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আরিফ ভাই আমাদের নিয়ে একটা রেডিও স্টেশন চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও শেষাবধি আলোর মুখে দেখেনি-করোনার ধাক্কায় ভাটা পড়েছে। কিন্তু আলোর পথে যাত্রায় তিনি ক্লান্ত হননি-ক্ষান্ত দেননি। আর ক্ষান্ত দেননি বলেই অনেকের মধ্যে থেকেও ভীষণ রকমের আলাদা-স্বতন্ত্র সত্ত্বার এক দেশমুগ্ধ সজ্জন হাসান আরিফ। 

মানুষ সংলগ্ন বাতিঘর আরিফ ভাইয়ের বাসা পান্থপথ-লালমাটিয়ায় যেখানেই হোক না কেন, তার বনানীর অফিসসহ যখন যেখানেই যে কাজেই তিনি থেকেছেন সবসময় সবাইকে নিয়ে থেকেছেন-বিশেষ করে তরুণ সংস্কৃতি কর্মীদের জন্য তিনি সদা-সর্বদা হরিহর আত্মা ছিলেন। তার ঠিকানা হয়ে উঠেছিল এই শহরের অনেকের ঠিকানা।

হাসান আরিফের মাতৃভক্তি কেমন ছিল, তা যারা কাছে থেকে দেখেননি, কিংবা সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ করেননি তারা হয়তো ততোটা টের পাননি-যতোটা তিনি করেছেন। বায়েজিদ বোস্তামীকে না দেখার খেদ দূর হয়ে যেত আরিফ ভাইয়ের মাতৃশ্রদ্ধা দেখে। করোনার আগে আগে মাকে নিয়ে এসেছিলেন ধানমন্ডির এক চক্ষু হাসপাতালে। তখন আরিফ ভাইও কিছুটা অসুস্থ। তারপরও মাকে নিয়ে তিনিই এসেছিলেন-এমনকি মাকে যে ট্রলিতে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই ট্রলিটা তিনিই ঠেলে নিয়ে গেছেন অন্য কেউ নন। ড্রাইভার পাঠিয়ে-ভাড়াটে লোক দিয়ে মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করেননি-নিজের হাতে করেছেন সব এবং বলেছেন মা-তো আমার-ড্রাইভারের নন, সুতরাং দায়িত্বটা আমারই। মায়ের জন্য উৎসর্গিকৃত এমনই ছিলেন আরিফ ভাই ।

আরিফ ভাই সরাসরি রাজনীতির মানুষ ছিলেন না, কিন্তু রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং সেটা মনে প্রাণে ধারণও করতেন। প্রত্যেকটা বিষয় গভীর যুক্তি দিয়ে গ্রহণ ও বর্জনের সহজাত এক প্রবৃত্তি ছিল হাসান আরিফের মস্তো বড়ো গুণ। সংস্কৃতি কর্মীর দায় কি-লড়াইটা কতদূর  এবং কীভাবে সেটা জারি রাখতে হয় সকল ক্ষণে-সর্বমহলে তিনি ছিলেন তার সাক্ষাৎ এক প্রতিমূর্তি। জেলা শহর কুমিল্লা থেকে যে হাসান আরিফের যাত্রা, তার বিস্তার বহুমাত্রিক ও আলোকবাহী হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকায়। 
আট এর দশকের প্রারম্ভিক লগ্নের একজন আবৃত্তি কর্মী- সময় পরিক্রমায় নানা ভাবে খোলতাই করেছেন নিজেকে, গঠন করেছেন 'স্বরিত' নামের আবৃত্তি সংগঠন। আবৃত্তির দলগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠনে রেখেছেন স্বভাবজ সাংগঠনিক ক্ষমতার ইর্ষণীয় ‍ভূমিকা। এসবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পাদপ্রদ্বীপের আলোয় এবং নিজেকে অনিবার্য এক কর্মী-নেতারূপে করেছিলেন হাজের-নাজেল, হয়েছিলেন জোটের সাধারণ সম্পাদক। বড়দের শ্রদ্ধা-ভক্তি-মযাদা-সম্মান ও সম্মাননা কীভাবে জানাতে হয়, সতীর্থদের সামনে কীভাবে তাদেরকে উপস্থাপন করতে হয় তার ধারাপাত গুণতে এবং বর্ণমালা শিখতে আমাদেরকে হাসান আরিফের কাছে দ্বারস্থ হতে হবে বারেবারে- সংগত কারণে, যুক্তিযুক্ত বাস্তবতার নিরিখেই। রামেন্দুদা ( রামেন্দু মজুমদার), ছোটলু ভাই (আলী যাকের), বাচ্চু ভাই (নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু), মামুন ভাই (মামুনুর রশীদ), কুদ্দুছ ভাইসহ ( গোলাম কুদ্দুছ) প্রমুখের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অন্তর উৎসারিত। আবার সতীর্থদের- ছোটদের কীভাবে আপন করে নিতে হয়, হৃদয়ের উষ্ণতায় ভরিয়ে দিতে হয় চারপাশ- চৌহদ্দির সকল প্রান্ত তার ঔজ্জ্বল্য খুঁজে পেতে আমাদেরকে তার মনোজগতে স্নান করতে হবে, সংগত কারণে এবং অনিবার্যেভাবেই। 

হাসান আরিফের হৃদয়ের বারতায় আমরা কেবলই মন্ত্রোচ্চারণ শুনেছি আর ভেবেছি 'তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী'। তার মৃত্যু- অকালের এবং আকস্মিক। কিন্তু যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন তা অমেয় ও ঐশ্বর্যবান। জীবনের লোভ-লালসা, সুযোগ-সুবিধার উপরে উঠে তিনি 'যিশুর' জীবন যাপন করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ উচ্চারিত মন্ত্রে রেখেছেন আমাদের, 'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।'

Comments

The Daily Star  | English

Top criminals on extortion spree

In November last year, a contractor secured the work to demolish a building in Dhaka’s Moghbazar for Tk 16.5 lakh. Shortly afterwards, members of a local gang arrived at the site and demanded Tk 3 lakh to allow the work to proceed.

3h ago