সোনায় মোড়ানো তাহমিমার বয়ান
তাহমিমা আনামের বহুলপঠিত প্রথম উপন্যাস 'এ গোল্ডেন এজ', বাংলায় 'সোনাঝরা দিন'। রাজধানী ঢাকা এই উপন্যাসের কেন্দ্র, যদিও ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি কাহিনীর পরম্পরা। ঘটনা বাঁক নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে, পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর-পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পর্যন্ত। 'সোনাঝরা দিন' এর চরিত্রের প্রবহমানতা তরঙ্গায়িত হয় পাশের দেশ ভারতে, কলকাতার সল্টলেক ও পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরে।
১৯৭১ 'সোনাঝরা দিন' এর মূল সময়, অবশ্য কাহিনীর শুরু তারও প্রায় এক যুগ আগে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। শুরুরও শুরু থাকে বলে যে প্রবাদ বাক্য রয়েছে-তার সার্থক উপস্থিতি দেখা যায় এখানে। পরিচ্ছদগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্টত হয় পুরো বিষয় ও উপর্যুক্ত বয়ানের যৌক্তিকতা। পরিচ্ছদ নাম যেমন আগ্রহোদ্দীপক, তেমনি চিত্তাকর্ষকও বটে। আচ্ছা, এগুলোকে কি পরিচ্ছদ বলা শ্রেয়, নাকি উপশিরোনাম বলায় সঙ্গত।
তাহমিমা আনাম পরিচ্ছদ নামের মধ্য দিয়ে সামান্য কয়েকটি শব্দের ব্যবহারে উপন্যাসের একটা সহজ-সংক্ষিপ্ত-সরল পরিচয় দিয়েছেন যা পাঠককে নির্মোহ একটা নির্যাস যেমন দেয় তেমনি বইয়ে প্রবেশের ভূমিকাও পালন করে। একটু দৃষ্টি দিলেই আমরা উপর্যুক্ত সত্যকে মান্যতা দিতে বাধ্য হই। পরিচ্ছদগুলো হলো : মার্চ ১৯৫৯ সূচনা; মার্চ ১৯৭১ সূর্যের দিকে পেছন ফেরা সোনা; ২৫ মার্চ ১৯৭১ অপারেশন সার্চলাইট; এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার; মে বাংলার কসাই টিক্কা খান; জুন আই লাভস ইউ, পরগি; জুলাই লালমুখো পাখি; আগস্ট সেপ্টেম্বর অক্টোবর সল্টলেক; নভেম্বর তুমি নাও আমার সন্তাপ; ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
সোনাঝরা দিন-এর মূখ্যসময় ১৯৭১ হওয়ায় এতে ৩টা দেশ যুক্ত হওয়া অনিবার্যভাবে। এক. বাংলাদেশ-সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া এক দেবশিশু-৭১ এর দিনগুলো যারা কাছে সোনাঝরা দিন তুল্য, বিশ্বমানচিত্রে যাকে এক প্রজন্মের ব্যবধানে দুইবার যুঝে নিতে হয়েছে পরম প্রিয়-মনুষ্য জীবনের আকাঙ্ক্ষার ধন স্বাধীনতাকে দুই. পাকিস্তান অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান-স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মকালীন সময়ে যে ছিল খড়গহস্ত-অবিবেচক ও প্রকাশ্য শক্রর ভূমিকায়। তিন. ভারত-স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মক্ষণে যে ছিল বন্ধুর ভূমিকায়-সবার থেকে হৃদয়বান এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকায় উদারহস্ত-উৎসর্গীকৃত প্রাণের মহৎ এক মৈত্রেয়।
তাহমিমা সন্তর্পণে এবং প্রখর সৃজনশীলতায় ভারত উপমহাদেশের তিনটা দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ককে প্রযত্নে রেখেছেন। অন্যদিকে, উপন্যাসের প্রয়োজনে ব্যক্তির সম্পর্ককে দিয়েছেন অগ্রাধিকার এবং 'সবার ওপরে মানুষ সত্য'কে দিয়েছেন সর্বোচ্চ মহিমা ও মর্যাদা। চরিত্রের বিকাশ ও সময়ের স্বাভাবিকতাকে ঔপন্যাসিক খোলতাই করেছেন তাদের পারস্পরিক আদানপ্রদানের গতিপ্রকৃতির সহজাত বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে।
৪৭ পূর্ব সময়ে যে ভূখণ্ড-দেশ ছিল পৃথিবীর একমাত্র উপমহাদেশ। ৪৭ এ তা হয়ে উঠলো খণ্ডিত-পৃথক দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। দেশ হিসেবে পাকিস্তানের জন্মই আবার এমনভাবে হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো সংজ্ঞায় তার জন্য প্রযোজ্য নয়। একই কিংবা পাশাপাশি ভূখণ্ডের-সংস্কৃতির-জল হাওয়া আকাশের না হয়েও শুধু ধর্মের কারণে জন্ম দেওয়া হলো অদ্ভুত এক রাষ্ট্র পাকিস্তান। ৭১ এই ভূখণ্ডের মানুষকে ৪৭ এর সেই ভুলের সংশোধনের সুযোগ এনে দিল ঠিকই। কিন্তু সেই সংশোধনে কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হলো বাংলাদেশের মানুষদের-বাঙালিকে তার অনুপম দলিল তাহমিমার উপন্যাস 'সোনাঝরা দিন'। রেহানা, সোহেল, মায়া সেই সময়ের আগ্নেয় সব চরিত্র।
তাহমিমার উপন্যাসেও সেই প্রসঙ্গের হাজের-নাজেল রয়েছে জোরালো ও প্রচ্ছন্ন উভয়রূপেই। রেহানা ৪৭-এর বেদনাবিধুর সময়ের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা এক নারী। যেমনটা ছিলেন জাহানারা ইমাম, জন্মেছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদ-তারপর নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার প্রধানতম সারথি, মুক্তিকামী মানুষের মা-৭১ এর দিনগুলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয়- নির্ভরতার জায়গা। কেন, জাহানারা ইমামের প্রসঙ্গ তা একটু পরে বলি, তার আগে ৪৭ এর প্রসঙ্গ আসি।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটো দেশের জন্ম হয়, যদিও সেই জন্ম সবার কাছে খুব বেশি স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল না। যে ব্রিটিশ রাজ বাণিজ্যের নামে-দেশ শাসনের নামে প্রায় দুশো বছর আমাদেরকে লুণ্ঠন-শোষণ-নির্যাতন ও প্রাণ সংহার করলো, দুটো দুর্ভিক্ষের জন্ম দিয়ে সংঘটিত করলো ভয়ঙ্কর এক গণহত্যা-তারাই নির্ধারণ করে দিলো কেমন হবে ভারতের স্বাধীনতা, অখণ্ড ভারতকে তারা শুধু খণ্ডিতই করলো না, সীমানা নির্ধারিত হলো তাদের আমদানি করা র্যাডক্লিফের খেয়াল-খুশিমতো, মর্জিমাফিক এবং অজ্ঞতা অনুযায়ী।
ব্রিটিশ বেনিয়ারা স্বাধীন দুটি দেশের অনুমোদনের পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে 'জাতিভাগ' করে জন্মদিল ঐতিহাসিক এক ক্ষত- মর্মন্তুদ এক অধ্যায়। পাঞ্জাব ও বাংলায় শুধুমাত্র এই কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিটেমাটি ছাড়াই কেবল হলো না, তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো অসহায় ও করুণ মৃত্যুর পথ। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাবিধুর গণহত্যার শিকার হলো জাতিভাগজনিত (দেশভাগ বলে পরিচিত।) উদ্বাস্তু-উন্মুল মানুষ। এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই কথাটি স্মরণযোগ্য: 'আমাদের দেশপ্রেম খাঁটি ছিল বলে দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু আমাদের জাতিপ্রেমে খাদ ছিল তাই দেশ খণ্ডিত হল।'
১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা পেল পাকিস্তান ও ভারত। বাংলা ভাগ হয়ে পূর্ব অংশ যুক্ত হলো পাকিস্তান নামক অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের । কেবল ধর্মের দোহাইয়ে যাত্রা করে পাকিস্তান নামের এক আজব দেশের। ৭১ বাঙালিকে দিলো, আজব রাষ্ট্র থেকে মুক্তির মন্ত্র-আপন শক্তিতে বলিয়ান হওয়ার ধারাপাত। বিনিময়ে বাঙালিকে স্বীকার করতে হলো সর্বোচ্চ ত্যাগ। শহর ঢাকার ধানমন্ডির 'সোনা' বাড়ি যার সাক্ষী। সোনা বাড়ি থেকে কি সোনাঝরা দিন? নাকি ৭১ এর সোনায় মোড়ানো দিনগুলো থেকে সোনাঝরা দিন? একথাতো সর্বৈবভাবে সত্যি, ৭১ এর প্রতিটা দিনই বাঙালির জন্য গর্ব ও গৌরবের। যতো কষ্ট-বেদনা ও আত্মোৎসর্গের ঘটনা ঘটুক না কেন, তার সবটাই যে পরম আনন্দের স্বাধীনতার লক্ষ্যে নিবেদিত। এই ভাবনা থেকেই কি এমন নামকরণ 'এ গোল্ডেন এজ', অথবা 'সোনাঝরা দিন'।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রেহানা, প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই জাহানারা ইমামের কথা এসেছে। রেহানার মধ্যে সাফিয়া বেগমের উপস্থিতি প্রবলভাবে লক্ষ্যণীয়। সাফিয়া বেগম হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদ আজাদ-এর মা। জাহানারা ইমাম, সাফিয়া বেগম কিংবা রেহানা এদের প্রত্যেকের লড়াই-ত্যাগ ও ঝুঁকি নেওয়ার সাহসগুলো সত্যিসত্যি সোনায় মোড়ানো কিংবা সোনার চেয়েও দামী। সেই জায়গা থেকে কি 'সোনাঝরা দিন', নাকি এগুলোর মিলিত ভাষ্য থেকেই সোনাঝরা দিন? কথাসাহিত্যিক তাহমিমা আনামের মুনশিয়ানা এখানেই যে, তিনি একের মধ্যে বহুত্বকে ধারণ করেন। একারণে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রেও উপস্থিতি দেখা যায় এক বা একাধিক জনের। রেহানার ক্ষেত্রে যেমন জাহানারা ইমাম কিংবা সাফিয়া বেগম। সোহেলের ক্ষেত্রে রুমী কিংবা আজাদকে মনে পড়ে। 'সোনা' বাড়ি যেন হয়ে ওঠে জাহানারা ইমামের বাড়ি- ৭১ এর দিনগুলো'র বর্ণিত ঘটনার ভিন্নপাঠ।
এই পাঠে অবশ্য আলতাফ মাহমুদও হাজির হয়। যদিও ঔপন্যাসিক স্পষ্ট করেই বলেছেন, 'এই গ্রন্থের সকল চরিত্র কাল্পনিক এবং জীবিত অথবা প্রয়াত বাস্তব কোন মানুষের সঙ্গে কোন ধরনের মিল সম্পূর্ণ কাকতালীয়।' তাহমিমা এটা বলতেই পারেন। পাঠক হিসেবে আমরা আমাদের করণীয় যা সেটাই করব-পাঠান্তে সেই পোস্টমর্টেমের দিকেই অগ্রসর হব। কারণ পাঠক কোনো জড়বস্তু নয়, নয় কোনো সফটওয়ার কিংবা রোবটসদৃশ কিছু। সে যেহেতু রক্ত মাংসে গড়া সজীব-সপ্রাণ এক মানুষ এবং এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর, কিংবা পূর্বপুরুষের-জাতির আবেগ ও মূল্যবোধ জড়িত সেহেতু পাঠান্তে নানাকিছু তালাশ ও জারিজুরির কারণ খুঁজে বের করা যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক বৈকি।
একারণেই শুধু রেহানা কিংবা সোহেল নয়, আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, এই উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মায়া কার মতো, কোন উৎস থেকে তাঁর অন্বেষণ। মায়া-রেহানার মেয়ে-যার সঙ্গে অন্যকে মেলানো যায় না সেভাবে, আবার পরক্ষণে মিলিয়েও যায় বলে প্রতিভাত হয়। মুক্তিসেনাদের কারও কারও বৈশিষ্ট্য রেহানাকে বিশিষ্ট করে তোলে। সোনাঝরা দিন যেহেতু ৭১ এর দিনগুলোরই পাঠ-অভিজ্ঞতার নির্যাস, সেইকারণে এ ধরণের সাযুজ্য এই উপন্যাসকে আরও বেশি বাস্তবানুগ এবং চরিত্র নিরপেক্ষ জায়গায় উত্তীর্ণ হওয়ার মোক্ষম সুযোগ দিয়েছে, এবং এখানেই এর বিশিষ্টতা এবং সৃজনে বিস্ময় জাগায়।
উপন্যাসের শেষটা আমাদেরকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, হতবিহব্বল করে এবং মুক্তিও দেয় দীর্ঘদিনের জাঢ্যতা থেকে। তাহমিমা লিখছেন : আজ তোমাকে বলতে এসেছি আমাদের যুদ্ধের কথা আর কীভাবে বাঁচলাম সে-কথা।
আজ যুদ্ধ শেষ হবে। আমি হাজার বছর পেরিয়ে এসেছি। নিজেকে কদর্য আর শ্রান্ত লাগছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি।
ছিয়ানব্বই দিন একজন মানুষ ছিল আমাদের বাসায়। প্রথম দিকে আমার খুব রাগ হতো যে ও আছে, কারণ ও সোহেলকে গেরিলা হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছিল আর দেশকে রক্ষা করার জন্য ওর ভেতরে এমন এক ধরণের গোঁ ছিল, যা যুদ্ধে যোগ দেয়ার ঠিক আগে সোহেলের চোখে আমি ধিকিধিকি জ্বলতে দেখেছি।
এই উন্মাদ সময়ের ভেতরে অনেক অনেক দিন পর এই প্রথম পৃথিবীটাকে যথার্থ বলে মনে হলো। আমি এক নারীর গান শুনলাম, যার কণ্ঠে হাজার বছরের বেদনা বুঁদ হয়ে ছিল। সেই ছিয়ানব্বই দিনের অল্প কিছুটা সময় আমি তাঁকে ভালবাসলাম।… স্বামী আমার, শুধু এই জন্য, আমি প্রার্থনা করি, তুমি আমায় ক্ষমা করবে। আর আমি খোদার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আমায় ক্ষমা করবেন।
আজ যুদ্ধ শেষ হবে। নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে দস্তখত করবে আর আমি মাথা উঁচু করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব। তোমার মেয়ে আমার হাত ধরে থাকবে। ফুটপাত মানুষে মানুষে সয়লাব হবে কিন্তু মায়া তারই মধ্যে ভিড় ঠেলে সামনে এগোবে।… পথ সমতল ও ধুলোময়; আমাদের হৃদয় স্বপ্নমুখী, ভালোবাসামুখী, গৃহমুখী, প্রাণ খুলে আমরা গাইব- 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' আকাশ ফ্যাকাসে ও চকচকে, আর আজ যুদ্ধ শেষ, আজ আমি পতাকা আঁকড়ে ধরব, শ্বাস বন্ধ করে প্রতীক্ষায় থাকবো আমাদের ছেলেদের ফেরার।
আমি জানি, আমি কী করেছি।
এই যুদ্ধ কত শত ছেলে কেড়ে নিল, কেবল আমার ছেলেকে ছেড়ে দিল। এই সময়ে কত শত মেয়ে পুড়ে ছাই হলো, কেবল আমার মেয়ে দগ্ধ হলো না। আমি তা হতে দিইনি।'
এক্ষণে মন করা প্রয়োজন এই উপন্যাসের শুরুটা হয়েছিল কীভাবে : 'প্রিয়তম, আজ আমি বাচ্চাদের হারিয়ে ফেলেছি।' হারানোর পাঠ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের যাত্রা, শেষ হচ্ছেও আরও অধিক কিছু হারানোর মধ্য দিয়ে, কিন্তু সেসব হারানোর মধ্য দিয়েই রেহানা যে জয়ী হয়েছেন সেই সত্য উপস্থাপিত হয়েছে। রেহানা দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে ১৬ ডিসেম্বরের যে বয়ান করেছেন হাজির তা, আমাদেরকে শুধু মুগ্ধ করে না, রেহানার প্রতি সমব্যথী করে, শ্রদ্ধাও জাগায়। রেহানার অকপট স্বীকারোক্তি যেন তার শুদ্ধতা-পবিত্রতার জয়গান গেয়ে ওঠে এবং এইসব হওয়া ও হয়ে ওঠার পেছনে যিনি কারিগর হিসেবে পুতুল নাচিয়েছেন তিনি হলেন তাহমিমা আনাম। যার সৃষ্ট চরিত্রসমূহ মুক্তিযুদ্ধকে দিয়েছে ব্যক্তির জীবন ভাষ্যের নবতর মাত্রা-উষ্ণীষ জাগানিয়া সম্ভ্রম, সমীহ উদ্রেক করা শ্রদ্ধা ও প্রীতির বারতা।
'সোনাঝরা দিন' প্রসঙ্গে তাহমিমার বয়ান : 'মুক্তিযুদ্ধ, এর গল্প, কথা, কাহিনী আমাকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করে, আকুল করে আমার জন্য এ এক চেতনা জাগানিয়া সময় সেই মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আমি যখন ইংরেজিতে উপন্যাস লিখি তখন তা আরো একবার বিশ্বের কাছে হাজির হয় স্বমহিমায় যে অনুপ্রেরণা ও আবেগ আমার লেখায় কাজ করেছে আমি শুধু সেটি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছি আরো সব মানুষের মাঝে … আশা করছি 'এ গোল্ডেন এজ' উপন্যাসের অনূদিত রূপটি এ দেশের মানুষ এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মনোযোগ পাবে একই মমতায় ও অহঙ্কারে যা উপন্যাসটি লেখার সময় আমার ধমনীতে আমি টের পেয়েছি।'
'এ গোল্ডেন এজ' ইংরেজিতে থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন লীসা গাজী, সম্পাদনা করেছেন- মশিউল আলম, শিবব্রত বর্মণ, মফিদুল হক। অনুবাদক এ প্রসঙ্গে বলেন : 'এ গোল্ডেন এজ' এই সময়ের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখানে বলা প্রয়োজন এটি কোন ইতিহাসের দলিল নয়, তবে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও চেতনাসঞ্চারকতো বটেই। তাছাড়া বইটি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবারও ভাবতে বাধ্য করে প্রবাসে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা যখন বইটি পড়ে দেশ সম্পর্কে, স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হয় তখনই এর অপরিহার্যতা টের পাই আর সে কারণেই এই কাজটির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পেয়ে ভালো লাগছে।'
কমনওয়েলথ সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী সেরা প্রথম গ্রন্থ ২০০৮ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে তাহমিমা আনামের 'এ গোল্ডেন এজ'। বাংলা অনুবাদে এই উপন্যাসের প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দ্বিতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রকাশক দ্য ডেইলি স্টার বুকস।
গ্রেট ব্রিটেনের জন মারে (পাবলিশার্স) কর্তৃক ২০০৭ সালে মূল ইংরেজি প্রথম প্রকাশিত। ইংরেজি উপন্যাসের একেবারে শুরুতেই একটা মানচিত্র রাখা হয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে ঢাকা থেকে লাহোর, কলকাতার সল্টলেকের দূরত্ব। মানচিত্রটি ত্রিদেশীয় বা ত্রিস্থানীয় দূরত্বকেই কেবল তুলে ধরেনি, ঢাকা ও লাহোর যোগাযোগ যে অন্য দেশের ভূমি-জল-কিংবা আকাশ ব্যবহার না করে কোনভাবেই সম্ভব নয় সেটা স্পষ্ট ও প্রগাঢ়ভাবে তুলে ধরেছে। দেখানো হয়েছে 'চিকেন নেক'ও। যাতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ নামে সদ্য যে দেশটা জন্মাতে যাচ্ছে বিশ্ব ভূগোলে তার গুরুত্ব কতোখানি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এবং ভারতের অখণ্ডতা রক্ষায় বিশেষ করে তাদের সেভেন সিস্টারকে এক পতাকা তলে ধরে রাখতে তারও ইঙ্গিত দেয়। অথচ বাংলা অনুবাদে সেই মানচিত্রটা নেই।
তাহমিমা অতীতকে ভুলেননি বলেই 'সোনাঝরা দিন' এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্টা হতে পেরেছেন। যে উপন্যাস ইতিহাস কিংবা রাজনীতির বাইরে গিয়ে ইতিহাসের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে জারি রেখেছে ব্যক্তির লড়াইয়ের জয়গান। ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাসে যেভাবে ইতিহাস হাজের-নাজেল হয় এবং ফিকশনকে প্রায়শ নিয়ে যায় নন ফিকশনের দিকে। তাহমিমা সেখানে পুরোটাই ব্যতিক্রম-ভিন্নমাত্রার এক সৃজনশিল্পী। এখানেই তাহমিমা স্বতন্ত্র-শক্তিশালী এবং কথাসাহিত্যে ৭১'র ব্যক্তির ইতিহাস বর্ণনায়-উপস্থাপনে উদাহরণ জাগানিয়া এক নাম-'এ গোল্ডেন এজ', অনবদ্য দলিল-অনুপম সাক্ষ্য সোনাঝরা দিন।
Comments