শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ
বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন দু'হাত ভরে লিখেছেন। তার সময়ে আরও অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু, তাদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের মূল পার্থক্য ছিল হয়তো লেখার ভঙ্গিতে। তার লেখাতে এক ধরনের মোহ ছিল, জাদু ছিল। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জাদুকর।
আবার হুমায়ূন আহমেদকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তুলনা করলেও হয়তো ভুল হবে না। তার কলম হয়ে উঠেছিল হ্যামিলনের সেই বাঁশি। আর সেই কলম দিয়েই তিনি একটি প্রজন্মকে বইমুখী করেছিলেন।
আগেই বলেছি হুমায়ূন আহমেদের লেখাতে এক ধরনের মোহ ছিল, জাদু ছিল। তার লেখা যারা পড়েছেন নিশ্চয়ই এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না। সাধারণত তিনি খুব সহজ ভাষা এবং ছোট ছোট বাক্য লিখতেন। অসাধারণ গল্প বলা এবং সেই গল্পকে লেখার শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার দারুণ ক্ষমতা ছিল তার। তিনি এমনভাবে লিখেছেন যা পড়তে গিয়ে পাঠককে বিরক্ত হতে হতো না। বরং অদ্ভুতভাবে তিনি পাঠককে বইয়ের মধ্যে আটকে রাখতে পারতেন। এই ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। এ জন্যই হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ম্যাজিশিয়ান।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর কনকনে এক শীতের রাতে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে জন্ম নেন নন্দিত এই কথা সাহিত্যিক। ফয়জুর রহমান-আয়েশা ফয়েজ দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। তাই বাবা-মায়ের খুব প্রিয় ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। জন্মের আগে তার বাবার ধারণা ছিল তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হবে। বাবা তো বড় মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন, ফ্রক বানিয়ে রেখেছিলেন৷ কিন্তু, মেয়ে না হয়ে ফয়জুর রহমান-আয়েশা ফয়েজের ঘরে জন্ম নেয় ছেলে সন্তান। এ জন্য অবশ্য দীর্ঘদিন তাকে মেয়েদের মতো সাজানো হতো। মা আয়েশা তার লম্বা চুলে মেয়েদের মতো বেণি করে দিতেন।
ছেলেবেলা বাবা ফয়জুর রহমানের সঙ্গে নামের মিলে রেখে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। এ ছাড়া, তার ডাকনাম ছিল কাজল। তখন তাকে সবাই কাজল নামেই চিনত এবং এই নামেই ডাকত। তার বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
হুমায়ূন আহমেদের পরিবার ছিল সাহিত্যমনা পরিবার। তাই তার ভিতটাও পরিবার থেকে গড়ে উঠেছিল। তাদের বাসায় নিয়মিত সাহিত্য আসর বসত। সেখানে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কবিতা লেখার প্রতিযোগিতা হতো।
ছেলেবেলা স্কুলের প্রতি হুমায়ূনের তেমন টান ছিল না। পড়ালেখাতেও খুব মনোযোগী ছিলেন না। তবে, প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে তিনি নিজেকে পাল্টে ফেলেন। পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন। রেজাল্ট প্রকাশের পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন৷ এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন৷ সেখানেও মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন৷ এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে৷ ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন এবং একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন।
তবে, লেখালেখি যার স্বপ্ন, আরাধনা—তার তো শিক্ষকতা মানায় না। তাই অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মনোযোগী হলেন নিজের লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে।
চলচ্চিত্র নির্মাণে দারুণ সফল ছিলেন এই কিংবদন্তি। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমনি'৷ এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। হুমায়ূনের প্রথম চলচ্চিত্রটি ৮টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। এ ছাড়া তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র— শঙ্খনীল কারাগার, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, নন্দিত নরকে, প্রিয়তমেষু, দারুচিনি দ্বীপ, আমার আছে জল, ঘেটুপুত্র কমলা ইত্যাদি। এর মধ্যে শ্যামল ছায়া ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এটি অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল।
নাট্যকার হিসেবেও তিনি পেয়েছিলেন আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা। এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, সবুজ সাথী, উড়ে যায় বকপক্ষী, এই মেঘ এই রৌদ্র, কালা কইতর, চন্দ্র কারিগর ইত্যাদি নাটক দর্শক মহলে খুবই সাড়া ফেলেছিল।
১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশিত হয়। প্রথম বই দিয়েই আলোচনায় আসেন তিনি। সেই যে শুরু, তা চলেছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই সময়ে দুই শতাধিক উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদের গদ্যে বরাবরই মধ্যবিত্তের জীবনের গল্প উঠে এসেছে। এ জন্য হয়তো তার লেখা এত পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো আলোড়িত করেছিল পাঠককে।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে- মিসির আলী, হিমু, শুভ্র ইত্যাদি। এরমধ্যে মিসির আলী সবসময় লজিক নিয়ে কাজ করে। অন্যদিকে হিমু তার বিপরীত। হিমু সবসময় এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে৷ এই দুটি চরিত্রে দিয়ে পাঠককে লজিক ও এন্টি লজিকের দোলাচালে দুলিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু চরিত্রকে তরুণ পাঠকের মগজে ও মননে গেঁথে দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু ভক্তরা তো হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে বইমেলাতেই চলে আসতেন। এখনো হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন কিংবা প্রয়াণ দিনে হলুদ পাঞ্জাবী পরে তাকে শ্রদ্ধা জানান। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ হিমু কিংবা মিসির আলী বা শুভ্র হয়ে সহস্র বছর বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নন্দিত এই কথাসাহিত্যিককে তারই প্রিয় গাজীপুরে নুহাশপল্লীর লিচুতলায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
হুমায়ূন আহমেদ জোস্না দেখতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন বৃষ্টির টুপটাপ কিংবা ঝুমঝুম শব্দ। নুহাশ পল্লীতে এখনো জোস্না নামে, এখনো বৃষ্টি নামে। কিন্তু, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ আপনাকে ছাড়া সেই বৃষ্টি, সেই জোস্না বড়ই বিবর্ণ! হয়তো ওরাও আপনাকে খুব মিস করে। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন ভালো থাকবেন প্রিয় ম্যাজিশিয়ান। শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।
Comments