আদুভাইয়ের অন্তরালে আবুল মনসুর আহমদ

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স/ স্কেচটি সংগ্রহীত

একটি কবিতাই একজন কবিকে বিখ্যাত করে দিতে পারে। শিল্পের এমনি শক্তি। যেমন যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'কাজলা দিদি' কবিতাটি এর দীপ্র প্রমাণ। কাজলা দিদির অন্তরালে পড়েছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী। 'আদর্শ ছেলে' শিরোনামে কবিতা লিখেছেন– কুসুম কুমারী দাশ। এক কবিতাই তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছেন। তেমন একটি গল্প 'আদুভাই' লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ। 'আদুভাই' শব্দটি অনেকটা মিথের মতো হয়ে গেছে।

তার আয়না, ফুড কনফারেন্স, আত্মকথা, বাংলাদেশের কালচার, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থসমূহ শিক্ষিত সমাজে বহুল সমাদৃত। কিন্তু শিক্ষিত-অশিক্ষিত পূর্বাপর জনগণ আদুভাই নামটির সঙ্গেও কোনো না কোনোওভাবে পরিচিত। কেননা, আদুভাই নামটি তারা খেলার মাঠ থেকে শুরু করে সংসদ, মঞ্চ ছবি-নাটকে সর্বত্র ব্যঙ্গ করেতে শোনা যায়। অর্থাৎ আদুভাই চরিত্রটি নিছক বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা খেলার মাঠ, চায়ের আড্ডা, বক্তৃতার মঞ্চ, গল্পের আসর কিংবা নাটক-নভেলেও প্রাসঙ্গিক। ছোটবেলায় আদুভাই গল্প পড়ে কেউ কেউ হেসে গড়াগড়ি খেয়েছেন, শেষে আবার মন খারাপও করেছেন- এমন মন্তব্যও শোনা যায়।
আদুভাইয়ের ক্লাস সেভেনে দীর্ঘদিন পড়া এবং অবশেষে ক্লাস এইটে ওঠার করুণ কাহিনি নিয়ে আবর্তিত হয়েছে গল্পটি। গল্পটির শুরু থেকেই আমরা হাসির ছটা লক্ষ্য করি। প্রসঙ্গত গল্পের প্রথমাংশ তুলে ধরা হলো:

"আদুভাই ক্লাস সেভেনে পড়তেন। ঠিক পড়তেন না বলে পড়ে থাকতেন বলাই ভালো। কারণ ঐ বিশেষ শ্রেণি ব্যতীত আর কোনো শ্রেণিতে তিনি কখনো পড়েছেন কি না, পড়ে থাকলে ঠিক কবে পড়েছেন, সে কথা ছাত্ররা কেউ জানত না। শিক্ষকরাও অনেকে জানতেন না বলেই বোধ হতো। শিক্ষকরাও অনেকে তাঁকে 'আদুভাই' বলে ডাকতেন। কারণ নাকি এই যে, তাঁরাও এককালে আদুভাইর সহপাঠী ছিলেন এবং সবাই নাকি ঐ এক ক্লাস সেভেনেই আদুভাইর সঙ্গে পড়েছেন।"

প্রমোশনের ব্যাপারে যখন কেউ কিছু বলত তখন তিনি যুক্তি দিতেন: "যে গাছ লক্ লক্ করে বেড়েছে, সামান্য বাতাসেই তার ডগা ভেঙেছে। অর্থাৎ উন্নতি আস্তে আস্তে হওয়াই ভালো বা সব সাবজেক্টে পাকা হয়ে উঠাই ভালো।"
পড়াশোনায় ভালো না হলেও আচার-ব্যবহার, আদব-কায়দা, চালচলনে সে বিনয়ী ছিল। সর্বদা সামনের বেঞ্চে বসা, শিক্ষকদের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, শিক্ষকদের কথায় সায় দেয়া, প্রয়োজনমতো নোট করা, ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকা, সময়মতো স্কুলে পৌছানো এবং সচ্চরিত্রবান- সমস্ত ভালো গুণে গুণান্বিত ছিল আদুভাই। সেজন্য স্কুলের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্কুল-কামাই না করা ও সচ্চরিত্রতা- এ দুটোর জন্য বরাবরই সে পুরষ্কার পেত।

আদুভাইয়ের নির্বুদ্ধিতা বা সরলতার দরুন তার প্রতি লেখকের মমত্ববোধ বেড়ে যায় এবং ঘনিষ্ঠতাও হয়। দীর্ঘ চার বছর পর লেখক যখন ম্যাট্রিকের টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছেন, তখনো আদুভাই ক্লাস সেভেনে। প্রমোশনবিমুখী আদুভাই একদিন প্রমোশনের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কারণ তার ছেলে সে-বার ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। গল্পের হাসির ছটা শতভাগে পৌছায় বাপ-ছেলে একই ক্লাসে পড়ার মধ্য দিয়ে। লেখকের 'হুযুর কেবলা' গল্পের পীর সাহেব যখন কলিমনকে বিয়ের ফন্দি আঁটেন তখন সে হাসিটা পূর্ণতা পায়। আবার 'আহলে সুন্নত' গল্পে যখন পিতা কৌশলে এক বুড়ির সঙ্গে হালিমের বিবাহ ঠিক করেন তখন হাসির বন্যায় ভেসে যায় পাঠক সমাজ।

যাহোক, অগত্যা আদুভাইয়ের বিপদ উপলব্ধি করে লেখক তার প্রমোশনের জন্য বিভিন্ন শিক্ষকের বাসায় গেলেন। ধস্তাধস্তি করলেন। লেখকের আন্তরিক চেষ্টা স্বত্তেও আদুভাইয়ের প্রমোশন হলো না। স্কুলের গেটের সামনে শিক্ষকের এমন অবিচারের বিরুদ্ধে আদুভাই বক্তৃতা দিলেন। 

আদুভাইয়ের ভাষ্য:
"হাঁ,প্রমোশন আমি মুখ ফুটে কখনো চাইনি। কিন্তু সেজন্যই কি আমাকে প্রমোশন না দেওয়া এঁদের উচিত হয়েছে? মুখ ফুটে না চেয়ে এতদিন আমি এঁদের আক্কেল পরীক্ষা করলাম; এঁদের মধ্যে দানাই বলে কোনো জিনিস আছে কি না, আমি তা যাচাই করলাম। দেখলাম, বিবেচনা বলে কোনো জিনিস এঁদের মধ্যে নেই। এঁরা নির্মম, হৃদয়হীন।"

তার ধারনা ক্লাস সেভেন ডিঙ্গোতে পারলে ক্লাস এইটে পাশ করতে পারতেন। অনেকে ম্যাট্রিক-আইএ- তে কোনোমতে পাশ করে বিএ-এমএ- তে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার যুক্তিও তিনি তুলে ধরলেন। কিন্তু শিক্ষকরা এসব কথায় কান দিলেন না। যার দরুন এমন পড়াশোনা শুরু করলেন যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তারপরেও পড়া ছাড়লেন না। অসুস্থ শরীরে পাল্কিতে চড়ে আদুভাই স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেন। প্রমোশন উৎসবের আগেই অসুস্থ আদুভাই মর্ত্যলোকের মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। 

Here sleeps Adu Mia who was promoted from class VII to class VIII" কবরের ওপর মার্বেল পাথরে খোদাই করা এ উক্তিটি পাঠকের মনে বড়ই বেদনা জাগায়! গল্পের হাসির বন্যা কান্নার বাঁধে গিয়ে ঠেকে আদুভাইয়ের মৃত্যুর মাধ্যমে। 

গল্পটিতে ব্যঙ্গের কষাঘাতের ঝাঁঝ নেই। এতে নির্মল হাস্যরসের সঙ্গে করুণ হাস্যরসের সমন্বয় ঘটেছে। মনসুর গবেষক মো. চেঙ্গীশ খানের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য: " ব্যঙ্গ রচনা ছাড়াও আবুল মনসুর আহমদ যে রসরচনা সৃষ্টিতেও অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন 'আদুভাই' তার উদাহরণ।" আদুভাই লেখকের ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি, এতে সন্দেহ নেই। কেন্দ্রীয় চরিত্র ধরে গল্পের নামকরণ করা হয়েছে। গল্পটির নাম আদুভাই না হয়ে যদি যদুভাই কিংবা কাদুভাই হতো তাহলে এতোটা রেখাপাত করতো বলে মনে হয় না। আমরা যখন 'আয়না' ও 'ফুড কনফারেন্স' গ্রন্থদ্বয়ে তাঁর চিন্তা-সৌকর্য নিয়ে ভাবি তখন এর বাইরে থেকে আরেকটি গল্প আবেদন জানায়, সেটি আদুভাই।'

কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, আদুভাই গল্পের স্রষ্টাকে- তা অনেকেই বলতে পারে না। আদুভাইয়ের নাম জানেন অথচ আবুল মনসুরের নাম জানেন না! ব্যক্তিমানবের চেয়ে সৃষ্টকর্মের পরিচয়টাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। আদুভাইয়ের নাম শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদের নাম শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া সুলভ। জনসাধারণের কাছে আবুল মনসুর অপেক্ষা আদুভাই বেশি পরিচিত। আদুভাই নামটি ব্যক্তি আবুল মনসুর নামকে আড়াল করেছেন। অর্থাৎ আদুভাইয়ের অন্তরালে পড়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। সৃষ্টি দেখেও মানুষ  স্রষ্টাকে ভুলে যায়- কী দুর্দৈব!

আমার ধারণা মাদ্রাসা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়- সব জায়গায় 'আদুভাই' আছে। সুতরাং কেবল গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা, বিষাদসিন্ধু তথা স্বর্ণের সিন্ধুতে আবদ্ধ না থেকে পথে পড়ে থাকা হীরার টুকরোর সন্ধান করতে পারলে সামাজিক সংকট কিছুটা হলেও নিরসন হতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

4h ago